খাওয়ারিজদের উত্থান: সিফফিনের পর বিদ্রোহের কারণ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ইতিহাসের পাতায় কিছু মুহূর্ত থাকে, যা সভ্যতার গতিপথকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। হিজরি প্রথম শতকের রাজনৈতিক ও আদর্শিক টানাপোড়েনের এক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সেই সন্ধিক্ষণ, যখন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের পর মুসলিম সমাজ গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়। তখন রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত, ন্যায়বিচারের মানদণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখে এবং রাজনৈতিক বিভাজন তীব্রতর। এই সংকটের প্রেক্ষাপটেই খিলাফতের ভার গ্রহণ করেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু।
অন্যদিকে শামের গভর্নর হযরত মুয়াবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট আত্মীয় এবং একজন বিচক্ষণ প্রশাসক ছিলেন, স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন— যতক্ষণ না শহীদ খলিফার হত্যাকারীদের বিচার ও প্রতিশোধ সম্পন্ন হয়, ততক্ষণ তিনি নতুন খলিফার আনুগত্য গ্রহণ করবেন না।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবতাবোধসম্পন্ন। তাঁর অভিমত ছিল, সমগ্র সাম্রাজ্যকে প্রথমে সুসংহত করতে হবে; নতুবা বিচারের নামে তড়িঘড়ি করা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকে আরও বিপর্যস্ত করবে। হত্যাকারীরা সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে গিয়েছিল, তাদের চিহ্নিত করা ছিল দুষ্কর এবং শরীয়তের শর্তানুসারে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ করা ও শাস্তি নিশ্চিত করা ছিল এক দীর্ঘতর প্রক্রিয়া। অপরদিকে, হযরত মুয়াবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু আশঙ্কা করছিলেন সময় যত বিলম্বিত হবে, হত্যাকারীরা তত ছড়িয়ে পড়বে এবং শাস্তির আওতার বাইরে চলে যাবে।
এই মতবিরোধ ক্রমশ এক গভীর দ্বন্দ্বের রূপ নেয়, যা ইতিহাসে “মারকাতু সিফফিন” নামে খ্যাত সেই মহাযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।
সিফফিনের প্রান্তরে মুখোমুখি সংঘর্ষ
যখন দুই মহাশক্তির মুখোমুখি সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, তখন একদিকে ইরাকি বাহিনীর নেতৃত্বে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, অন্যদিকে শামী বাহিনীর অধিনায়ক হযরত মুয়াবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু— উভয়েই তাঁদের নিজ নিজ নীতিতে অবিচল থেকে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন।
যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয় এবং হযরত মুয়াবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়, তখন তাঁর অন্যতম পরামর্শদাতা, কূটনৈতিক প্রজ্ঞায় অনন্য আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু এক যুগান্তকারী কৌশল প্রস্তাব করেন। তিনি পরামর্শ দেন, সৈন্যদের বর্শার ফলায় কুরআনের পাণ্ডুলিপি উত্তোলন করতে এবং ইরাকি বাহিনীকে আহ্বান জানাতে— আসুন, আমরা কুরআনের বিধানের আলোকে এই বিরোধের নিষ্পত্তি করি।
মাসউদীর বর্ণনা অনুযায়ী, শামী বাহিনীর পাঁচ শতাধিক সৈন্য বর্শার অগ্রভাগে কুরআনের পাণ্ডুলিপি উঁচিয়ে ধরে এবং চিৎকার করে বলে— “আল্লাহর কিতাব আমাদের মাঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক!”
তাহকিম: আদর্শিক বিভাজনের সূচনা
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এই কৌশলের অন্তর্নিহিত অভিসন্ধি অবলীলায় অনুধাবন করেছিলেন। তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে উপলব্ধি করেন যে, এটি শত্রুপক্ষের এক সুদূরপ্রসারী কূটকৌশল যা মূলত তাদের পুনর্গঠনের জন্য সময়সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং ইরাকি বাহিনীর অভ্যন্তরে মতপার্থক্য উস্কে দেবে। তাই তিনি তাঁর অনুসারীদের সতর্ক করে বলেন— এই আহ্বানের ফাঁদে পা দেওয়া আত্মঘাতী হবে।
কিন্তু ইরাকি বাহিনীর মধ্যে একটি অংশ যারা যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে মুক্তি চাইছিল, তারা এই আহ্বানকে এক পবিত্র আহ্বান বলে ধরে নেয় এবং জোরপূর্বক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাহকিম (সালিসির মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা) মেনে নিতে বাধ্য করে।
পরবর্তীকালে এই দলই “খারিজি” নামে পরিচিতি পায়, যারা ইসলামের মূলধারার দর্শন থেকে বিচ্যুত হয়ে চরমপন্থী এক মতবাদে পরিণত হয়।
খাওয়ারিজদের বিদ্রোহ ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি তাদের বৈরিতা
এই দল এতদূর চলে যায় যে, তারা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁকে “আমিরুল মুমিনীন” সম্বোধন করতেও অস্বীকৃতি জানায়। তারা প্রকাশ্যে তাঁকে সম্বোধন করে বলে—
“হে আলী! কিতাবুল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নাও, অন্যথায় আমরা তোমার সাথেও সেই আচরণ করব, যা আমরা উসমানের সাথে করেছি!”
তাদের বক্তব্য ক্রমশ কঠোরতর হতে থাকে, তারা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর অবস্থানকে তীব্র সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং তাঁকে তাহকিম মেনে নিতে বাধ্য করে। তারা নিজেদের অবস্থানের স্বপক্ষে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করত—
”أَلَمْ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ أُوتُوا۟ نَصِيبًۭا مِّنَ ٱلْكِتَـٰبِ يُدْعَوْنَ إِلَىٰ كِتَـٰبِ ٱللَّهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ يَتَوَلَّىٰ فَرِيقٌۭ مِّنْهُمْ وَهُم مُّعْرِضُونَ“
“তুমি কি দেখোনি সেই ব্যক্তিদের, যাদের কিতাবের জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল? যখন তাদের আহ্বান করা হয় যেন তারা আল্লাহর কিতাবের বিধান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সম্পূর্ণভাবে বিমুখ হয়ে পড়ে।” (সূরা আল-ই-ইমরান: ২৩)
এই তাহকিমের ঘটনা থেকেই খারিজিদের চূড়ান্ত উত্থানের সূচনা। প্রথমে তারাই যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তারাই একে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।