ইসলামের ইতিহাসে মুসলিমদের তাকফির (কাউকে কাফের ঘোষণা করা) করা এবং এই চিন্তার ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও গণহত্যা চালানো কোনো নতুন ঘটনা নয়। এটি একটি পুরোনো ধারা, যার ঐতিহাসিক উদাহরণ হলো খাওয়ারিজরা, যারা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, মুসলিমদের তাকফির করেছিল এবং তাদের হত্যা করেছিল।
এই খাওয়ারিজরা শুধুমাত্রই হযরত আলী এবং হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মধ্যে সমঝোতা ও সালিশকে কুফরি মনে করত না, বরং কবিরা গুনাহকারী এবং সাধারণ মুসলিমদেরও মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) ঘোষণা করে তাদের হত্যা করা জরুরি মনে করত। তাদের যুক্তি কেবল কুরআনের বাহ্যিক আয়াতের ওপর ভিত্তি করে ছিল না, বরং তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও ব্যক্তিগত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
এই খাওয়ারিজদের কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যার কারণে সাহাবাদের যুগে মানুষ তাদের “ক্বারিউল কুরআন” (কুরআন পাঠক) নামে ডাকত। যখন তারা বসরার দখল নেয়, তখন প্রায় ছয় হাজার মানুষকে হত্যা করে। এই ঘটনাটি “বসরায় ক্বারিদের দখল” নামে পরিচিত।
বসরা দখলের পর খাওয়ারিজদের এক বিখ্যাত নেতা দাহহাক কুফা আক্রমণ করে এবং সেখানেও দখল প্রতিষ্ঠা করে। সে কুফার জামে মসজিদে প্রবেশ করে, তরবারি তুলে তার হাজার হাজার সশস্ত্র অনুসারীর সামনে ঘোষণা করে যে, কুফার সকল মানুষকে এক এক করে আমার সামনে এসে তাদের কুফরি থেকে তওবা করতে হবে, অন্যথায় আমি এখানেও বসরার মতো সবাইকে হত্যা করব। দাহহাক বসরার মতো নৃশংসতা কুফাতেও পুনরাবৃত্তি করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ.–র ধৈর্য, প্রজ্ঞা এবং কৌশলের কারণে দাহহাকের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। অন্যথায় কুফাতেও বসরার মতো ধ্বংসযজ্ঞ ঘটত।
মাওলানা মানাযির আহসান গিলানি রহ. তাঁর “ইমাম আবু হানিফা রহ. কি সিয়াসী জিন্দেগি” বইয়ে এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সারসংক্ষেপ হলো, ঘোষণার পর ইমাম আবু হানিফা রহ. ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদে যান এবং দাহহাকের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন যে, তুমি কুফার লোকদের হত্যার আদেশ কেন দিয়েছো? দাহহাক বলল, কারণ এই লোকেরা মুরতাদ এবং মুরতাদকে হত্যা করা ওয়াজিব। ইমাম সাহেব রহ. বললেন, মুরতাদ সে-ই যে তার ধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে। কুফার লোকেরা সেই ঈমানের ওপরই আছে যেটার ওপর তারা জন্মগ্রহণ করেছিল, তারা তাদের ধর্ম পরিবর্তন করেনি। সুতরাং, তাদের মুরতাদ ঘোষণা করা ভিত্তিহীন।
ইমাম আবু হানিফার এই কথা দাহহাকের হৃদয়ে প্রভাব ফেলে এবং সে বলে, “আখতা‘না” (আমরা ভুল ছিলাম)। এরপর সে তার তরবারি নামিয়ে নেয় এবং তার সঙ্গীদেরও তরবারি নামিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়। এভাবেই কুফার লোকেরা খাওয়ারিজদের গণহত্যা থেকে রক্ষা পায়। সেই যুগে, যখন তাকফির, হত্যা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের বাজার অত্যন্ত গরম ছিল, এটি ছিল আমাদের অতীতের তিক্ত অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি।
আজ এই তাকফিরের চিন্তার এক নতুন ঢেউ মুসলিম বিশ্বের অনেক সংবেদনশীল অঞ্চলকে গ্রাস করেছে এবং ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো এটি থেকে পরিকল্পিতভাবে ফায়দা লুটছে। পরিস্থিতি এত গুরুতর হয়ে উঠেছে যে, মুসলিম উম্মাহর আলেম, বুদ্ধিজীবী এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা এ নিয়ে চিন্তিত এবং কোনো মুসলিমই চিন্তার স্তরে এই ফিতনা থেকে নিরাপদ নয়।
সমসাময়িক খাওয়ারিজ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী দলগুলো প্রায় এক শতাব্দী আগে আলজেরিয়ায় আবির্ভূত হয়েছিল। সেখানকার সকল ইসলামি সংগঠন এবং আন্দোলন “জাবহাতুন নাজাত আল-ইসলামি” (ইসলামিক সেভিয়র ফ্রন্ট) নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করে এবং নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিপরীতে আলজেরিয়ার জাতীয় রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে।
এই জোট নির্বাচনে অংশ নিতে সক্ষম হয় এবং প্রথম ধাপে প্রায় ৮০% ভোট পেয়ে বিশ্বব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে অবাক করে দেয়। এই শক্তিগুলো এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার চেষ্টা করে, নির্বাচন স্থগিত করা হয় এবং সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়।
এরপরে ইসলামি আন্দোলনগুলোকে দুর্বল এবং বিভক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর জন্য সব ধরনের যুলুম ও ষড়যন্ত্র করা হয়। একটি বড় ষড়যন্ত্র ছিল এই যে, খাওয়ারিজ-সুলভ চিন্তাধারা তৈরি করা, যাতে ইসলামি আন্দোলনগুলোর মধ্যে তাকফির ছড়িয়ে পড়ে এবং নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। দুঃখের বিষয় হলো এই ষড়যন্ত্র সফল হয় এবং এর ফলস্বরূপ এক দশকের মধ্যে প্রায় এক লক্ষ নিরপরাধ মুসলিমকে হত্যা করা হয়।
আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং মুসলিম বিশ্বের আলেমদের কাছে বারবার দাবি জানানো হয়েছিল যে, আলজেরিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন তৈরি করা হোক, যাতে মুসলিম উম্মাহ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, উম্মাহর মধ্যে গবেষণা, অধ্যয়ন, ডকুমেন্টেশন এবং প্রকৃত তথ্য অর্জনের আগ্রহ প্রায় শেষ হয়ে গেছে এবং আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তার ক্ষতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাবে।
আলজেরিয়ার পর এই অভিজ্ঞতা মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য দেশেও পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আমরা দেখেছি কিভাবে কিছু সিরীয় এবং ইরাকি প্রতিরোধ গোষ্ঠী তাকফির এবং যুদ্ধের পথে চলে গিয়েছিল এবং খাওয়ারিজদের মতবাদ দিয়ে তাদের লালন-পালন করা হয়েছিল।
আফগানিস্তানের জন্যও একই পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু শুকরিয়া যে, ইসলামি ইমারাত কিছু ক্ষেত্রে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে, যার কারণে জটিল পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে মোড় নিয়েছে। যেমন:
• আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত ব্যতীত সব ধরনের আদর্শিক, সংস্কারমূলক, নাগরিক এবং সামাজিক প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছে।
• ছোট-বড় সব ধরনের দল, সংগঠন এবং আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
• পুরো দেশে ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে (হানাফি ফিকহকে ভিত্তি করা হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়)।
• খাওয়ারিজদের চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, মতবাদ এবং ইতিহাসকে স্পষ্ট করা হয়েছে।
• তাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এবং কার্যকর অভিযান চালানো হয়েছে।
• আলেমগণ খাওয়ারিজদের সকল শাখার জন্য একটি অভিন্ন সংজ্ঞা এবং একটি রায় জারি করেছেন।
আলহামদুলিল্লাহ, এখন আমরা একটি ইসলামি সরকারের স্নেহময় ছায়াতলে আছি। পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো, সম্পদ বিদ্যমান, সুযোগ ও সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে এবং কাজ করার শক্তি দিন দিন বাড়ছে। সুতরাং, চিৎকার ও আফসোসের যুগ শেষ হয়েছে, বিতর্ক ও ঝগড়ার সময় পেরিয়ে গেছে। এখন লেখক, আলেম এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসুক এবং এই ফিতনা ও পরিকল্পনাগুলোর তদন্ত, যাচাই এবং ডকুমেন্টেশন করুক, যাতে বর্তমান উম্মাহ এবং আগত প্রজন্ম এই ফিতনা থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারে।