ইতিহাসের পাতায় উসমানি খিলাফত | পঞ্চদশ পর্ব

✍🏻 হারিস উবায়দাহ

যে সব উপাদান ওরহানকে তার লক্ষ্যে সফল করেছিল
ওরহান তার পিতা উসমানের অব্যাহত প্রচেষ্টার সুফল ভোগ করেছিলেন। আনাতোলিয়ার ভূখণ্ড দখল এবং উসমানীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে ভৌত ও মানসিক উপকরণ কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল, সেগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার তিনি করেছিলেন। পাশাপাশি তার নিজস্ব নিরন্তর প্রচেষ্টাও একে আরও সুদৃঢ় করেছিল। রাষ্ট্র সম্প্রসারণের জন্য তিনি যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তা ইতিহাসে নির্ণায়ক হিসেবে প্রমাণিত হয়। খ্রিস্টানরা টেরই পায়নি যে, উসমানীয় সাম্রাজ্য ইউরোপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা কেবল তখনই সচেতন হয় যখন মুসলিমরা সমুদ্র পেরিয়ে গ্যালিপোলি নগর দখল করে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য তখন পতনের দ্বারপ্রান্তে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ধর্মীয় ও সামাজিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত বাইজেন্টাইন সমাজ নিজেই নিজের ভিতর থেকে ভেঙে পড়ছিল। এই দুরবস্থাই উসমানীদের জন্য বাইজেন্টাইন ভূখণ্ড অন্তর্ভুক্ত করাকে সহজ করে দেয়। বলকান ও উসমানীদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধসমূহে যে সাফল্য মুসলিমরা অর্জন করে, তা ওরহানের দূরদর্শিতা ও উসমানী ঐক্যের সরাসরি ফল। ধর্মীয় ও মতাদর্শগত দিক থেকেও তারা ছিল অভিন্ন—সমগ্র সেনাদল সুন্নি মাযহাবের অনুগত ছিল।

অন্যদিকে বাইজেন্টাইন, বুলগেরীয়, সার্বীয় ও হাঙ্গেরীয় শাসনব্যবস্থার পারস্পরিক অনাস্থা যুদ্ধক্ষেত্রকে দুর্বল করে তুলেছিল। রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গড়তে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। রোম ও কনস্টান্টিনোপলের মধ্যকার ধর্মীয় মতবিরোধ এবং ক্যাথলিক গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব তাদেরকে ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল। এর ফলে দলাদলি, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বৈরিতা দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। এদিকে উসমানীরা এক অভিনব সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা চিন্তাগত ভিত্তি, প্রশিক্ষণপদ্ধতি ও আদর্শিক লক্ষ্যসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর তত্ত্বাবধান করতেন তাদেরই খ্যাতনামা নেতারা।

সুলতান মুরাদ প্রথম
সুলতান মুরাদ প্রথম ছিলেন সাহসী মুজাহিদ, দয়ালু ও ধার্মিক সম্রাট। তিনি শৃঙ্খলাপ্রিয় ছিলেন, গরিবদরদী এবং প্রজাদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। সৈন্যদের যত্ন নিতেন, অভাবীদের প্রতি সহমর্মী ছিলেন এবং আল্লাহর পথে ন্যায্য জিহাদকে ভালোবাসতেন। মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তাঁর সঙ্গীদের অধিকাংশই ছিলেন সেনাপতি, সামরিক কর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা, যাদের মতামত তিনি শূরা সভায় গ্রহণ করতেন।

তিনি একসাথে আনাতোলিয়া ও ইউরোপ উভয় অঞ্চলে সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারণ শুরু করেন। ইউরোপে বাইজেন্টাইন নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড আক্রমণ করে ৭৬২ হিজরি / ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দে এড্রিয়ানোপল (এদিরনে) দখল করেন। এ নগর বলকানে সুপ্রসিদ্ধ ছিল এবং কনস্টান্টিনোপলের পর বাইজেন্টাইনের দ্বিতীয় বৃহৎ নগর হিসেবে পরিচিত ছিল। ৭৮৬ হিজরি / ১৩৬৬ খ্রিস্টাব্দে এ শহর উসমানী রাজধানীতে রূপ নেয়। এর মাধ্যমে এই বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী এশিয়া থেকে ইউরোপে স্থানান্তরিত হয় এবং এড্রিয়ানোপল হয়ে ওঠে একটি ইসলামী রাজধানী।

রাজধানী স্থানান্তরের উদ্দেশ্যসমূহ ছিল—
১. এড্রিয়ানোপলের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগানো।
২. মুজাহিদদের কর্মকাণ্ড-সক্রিয় অঞ্চলগুলোর নিকটে অবস্থান করা।
৩. ইউরোপের যে সব ভূমি জিহাদের মাধ্যমে উন্মুক্ত হয়েছিল, সেগুলোকে সাম্রাজ্যে যুক্ত করা।

মুরাদের প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার ও সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করা। তিনি রাষ্ট্রোন্নতি ও ঐক্যের যাবতীয় নীতি ও নীতিমালা একত্র করেছিলেন। রাজধানীতে সম্রাট, আইনপ্রণেতা, আলেম, জ্ঞানীজন ও নানা শ্রেণির প্রতিনিধিদের জন্য সভা ও আসর বসাতেন। আদালতে কাজী নিয়োগ দেন, নগর ও মাদরাসার সুরক্ষা এবং ধর্মীয় কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানের জন্য সামরিক কেন্দ্র গড়ে তোলেন। রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে এড্রিয়ানোপলের অবস্থান সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। এমনকি ৮৫৭ হিজরি / ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে উসমানীরা কনস্টান্টিনোপল জয়ের পূর্ব পর্যন্ত এটি রাজধানী ছিল।

সুলতান মুরাদের মুখোমুখি ক্রুসেডীয় জোট
সুলতান মুরাদের জিহাদি ও দাওয়াতি আন্দোলন প্রবল বেগে চলছিল। তিনি একের পর এক ইউরোপীয় ভূখণ্ড জয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অবশেষে যখন মাকেদোনিয়া দখলের উদ্দেশ্যে বাহিনী প্রেরণ করেন, তাঁর বিজয়ের খ্যাতি দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। উসমানী অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ইউরোপীয় বলকানীয় ক্রুসেডীয় জোট গঠিত হয়। সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি ও অন্যান্য দেশের মানুষ এতে অংশ নেয়। তাদের সম্মিলিত বাহিনী ষাট হাজারে পৌঁছায়।

অন্যদিকে উসমানীয় সেনাপতি লালা শাহীন অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে এই বিরাট বাহিনীর মোকাবিলা করেন। মারিতজা (চিরমেন) নদীর তীরে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয় এবং যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলিমরা ক্রুসেডীয়দের জোরালোভাবে প্রতিহত করে। ক্রুসেডীয় বাহিনী ভেঙে পড়ে, সার্বিয়ার দুই নেতা নিহত হয় এবং মারিতজার সৈন্যরা বিপর্যস্ত হয়ে যায়।

হাঙ্গেরির রাজা বিস্মিত হয়ে পড়ে যে, মুরাদ—যিনি আনাতোলিয়ার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, কীভাবে এতো নগর জয় করতে পারলেন! মুরাদের অভ্যাস ছিল—বিজিত নগরে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে রাজধানীতে ফিরে যাওয়া।

মারিতজা নদীর বিজয়ের ফলাফল
১. এ বিজয়ের মাধ্যমে থ্রেস ও মাকেদোনিয়ার অঞ্চল দখল হয় এবং মুসলিম বাহিনী দক্ষিণ বুলগেরিয়া ও পূর্ব সার্বিয়া পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
২. বাইজেন্টাইন প্রভাবাধীন বুলগেরিয়া ও সার্বিয়ার ভূখণ্ড শরতের ঝরা পাতার মতো একে একে খসে পড়ে এবং মুসলিমদের শাসনের অধীনে আসে।

Exit mobile version