ইতিহাসের পাতায় উসমানি খিলাফত | ষষ্ঠদশ পর্ব

✍🏻 হারিস উবায়দাহ

উসমানী সালতানাত এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে চুক্তি
উসমানী সালতানাতের ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে পূর্ব ও পশ্চিমের দেশগুলো, বিশেষ করে দুর্বল দেশগুলো, ভীত হতে শুরু করে। এই কারণেই রাগুসা (Ragusa) প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই এর শাসকরা সুলতান মুরাদের দরবারে দূত পাঠান এবং বন্ধুত্বের চুক্তির প্রস্তাব করেন। এই চুক্তির ফলস্বরূপ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। চুক্তির একটি শর্ত ছিল যে রাগুসা প্রজাতন্ত্র উসমানী সালতানাতকে বার্ষিক ৫০০ দুকাত (যা সেই সময়ের মুদ্রা ছিল) খাজনা হিসেবে প্রদান করবে। এটিই ছিল উসমানী সালতানাত এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রথম চুক্তি।

কসোভোর যুদ্ধ
সুলতান মুরাদ তাঁর সেনাপতিদের কৌশল থেকে সরে এসে সরাসরি বলকানের দূরবর্তী অঞ্চলে অগ্রযাত্রা করেন। এই পদক্ষেপে সার্বিয়ার শাসকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় এবং তারা ইউরোপের অন্যান্য শাসকদের সহায়তায় এই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।

সার্বীয় বাহিনী বলকানে উসমানী সেনাবাহিনীর ওপর বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালায়, কিন্তু তারা বিশেষ কোনো সফলতা লাভ করেনি। এই সময় সার্বিয়া এবং বসনিয়ার অধিবাসীরা বুলগেরিয়ার বাসিন্দাদের সাথে চুক্তি করে এবং একটি ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় ক্রুসেডার বাহিনী প্রস্তুত করে, যার উদ্দেশ্য ছিল উসমানী বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি বড় হামলা করা।

এই পরিস্থিতিতে সুলতান মুরাদ পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তাঁর সেনাবাহিনীকে বলকানের কসোভো এলাকা পর্যন্ত নিয়ে আসেন। বলা হয় যে যুদ্ধের সময় সুলতান মুরাদের উজিরের কাছে পবিত্র কুরআনের একটি কপি ছিল। যখন উজির কুরআন মাজীদ খুললেন, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর চোখ এই আয়াতটির ওপর পড়ল: “হে নবী! মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করুন, যদি আপনাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল (স্থিরপদ) থাকে, তবে তারা দুইশো (কাফিরের) উপর জয়ী হবে, আর যদি আপনাদের মধ্যে একশো জন থাকে, তবে তারা এক হাজার কাফিরের উপর জয়ী হবে, কারণ তারা (কাফিররা) এমন লোক যাদের (বাস্তব) জ্ঞান নেই।” (সূরা আল-আনফাল: ৬৫)

সম্মানিত উজির এই আয়াতটিকে শুভ লক্ষণ মনে করলেন এবং এটিকে মুসলিমদের বিজয়ের সুসংবাদ হিসেবে ঘোষণা করলেন। এই ঘটনার পর পুরো সেনাবাহিনীর বিজয়ের ওপর বিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো। উভয় সেনাবাহিনী মুখোমুখি সারিবদ্ধ হলো, এবং কিছুক্ষণ পরেই তীব্র যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ মুসলিমদের স্পষ্ট ও নিশ্চিত বিজয়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হলো।

সুলতান মুরাদের শাহাদাত
কসোভোর যুদ্ধে সফলতার পর, সুলতান মুরাদ রহ. যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করছিলেন। তিনি শহীদদের লাশের মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলেন এবং তাঁদের জন্য দুআ করছিলেন, আহত সৈন্যদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন এবং তাঁদের চিকিৎসার নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

তখন লাশগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক সৈনিক হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। এই ব্যক্তি ছিল একজন সার্বীয়, যে নিজেকে মৃতদের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিল। সে সুলতানের দিকে ছুটে যায়, কিন্তু প্রহরীরা তাকে ধরে ফেলে। সে চালাকি করে অজুহাত দেখায় যে সে সুলতানের সাথে কথা বলতে চায় এবং তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। সুলতান মুরাদ রহ. প্রহরীদের তাকে ছেড়ে দেওয়ার ইশারা করলেন। সুলতান যেইমাত্র হাত বাড়ালেন, সেই ব্যক্তি ছুরি বের করে সুলতানের ওপর আক্রমণ করে বসল। সুলতান মারাত্মকভাবে আহত হন এবং ১৫ শাবান, ৭৯২ হিজরিতে আল্লাহর পথে শাহাদাতের মর্যাদায় ভূষিত হন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

সুলতান মুরাদের শেষ কথা
“আমার কাছে শুধু এতটুকু সময় আছে যে আমি আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করতে পারি। তিনি সকল গোপন কথা জানেন এবং এই ফকীরের দুআ কবুল করেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো প্রকৃত উপাস্য নেই, আর কৃতজ্ঞতা, প্রশংসা ও গুণগানের একমাত্র হকদার তিনিই। আমার শেষ সময় এসে গেছে, আমি নিজের চোখে ইসলামী সেনাবাহিনীর বিজয় দেখেছি। তোমরা সকলে আমার পুত্র বায়েজীদের অনুসরণ করো, বন্দীদের কষ্ট দিয়ো না বা তাদের অপমান করো না। আমি তোমাদের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, এবং আমার এই মহান ও সফল সেনাবাহিনীকে আল্লাহ তাআলার রহমতের হাতে সোপর্দ করছি। তিনিই আমাদের সালতানাতকে সকল মন্দ থেকে রক্ষা করবেন।”

এই বরকতময় শব্দগুলো উচ্চারণ করার পর, এই মহান ব্যক্তিত্ব ৬৫ বছর বয়সে তাঁর প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যান।

Exit mobile version