ইতিহাসের পাতায় উসমানি খিলাফত | অষ্টম পর্ব

✍🏻 হারিস উবায়দাহ

সেলজুক সাম্রাজ্যের অবসান

মালিক শাহের মৃত্যু-পরবর্তী কালে তাঁর তিন পুত্র ছিলেন—বরকিয়ারুক, মুহাম্মাদ সাঞ্জার ও মাহমুদ। মাহমুদ পরে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ নামে পরিচিত হন। তখনও তিনি শিশু ছিলেন, কিন্তু তাঁর হাতেই বায়আত নেওয়া হয়, কারণ তাঁর মাতা তুরকান খাতুন মালিক শাহের শাসনামলে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। মাহমুদ প্রায় দুই বছর (৪৮৫ থেকে ৪৮৭ হিজরি / ১০৯২–১০৯৪ খ্রিস্টাব্দ) শাসন করেন। তাঁর ও তাঁর মাতার মৃত্যু-পরবর্তীতে রুকনুদ্দীন আবুল মুফাফফর বরকিয়ারুক ইবন মালিক শাহ সিংহাসনে আরোহন করেন এবং ৪৯৮ হিজরি / ১১০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন।

এরপর রুকনুদ্দীন মালিক শাহ দ্বিতীয়ের প্রতি বায়আত করা হয়, কিন্তু ঐ বছরই তাঁর মৃত্যুর পরে গিয়াসুদ্দীন আবু শুজা মুহাম্মাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ৫১১ হিজরি / ১১২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন।

সেলজুক সাম্রাজ্যের শেষ শাসক ছিলেন গিয়াসুদ্দীন আবু শুজা মুহাম্মাদ, যার রাজধানী ছিল মাওয়ারাউননাহর। তাঁর শাসন খোরাসান, ইরান ও ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অবশেষে ৫২২ হিজরি / ১১২৮ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক সাম্রাজ্য খাওয়ারিজম শাসকদের হাতে পতিত হয়।

মাওয়ারাউননাহরে সেলজুকদের এই মহান সাম্রাজ্যের পতনের পর তারা ভেতরে ভেতরে বিভক্ত হয়ে যায়, ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়, শক্তি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে এবং তারা বহু দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সিংহাসন দখলের জন্য ক্রমাগত দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলতে থাকে। একক বৃহৎ সাম্রাজ্য ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইমারাতে বিভক্ত হয়ে যায়।

এই সব ছোট ছোট রাজ্য কোনো এক শাসকের আধিপত্য মানতে প্রস্তুত হয়নি। তারা সুলতান তুঘরিল বেগ, সুলতান আলপ আরসলান কিংবা মালিক শাহের মতো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। বরং প্রতিটি অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যায়, প্রতিটির নিজস্ব শাসক ছিল এবং এই ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও ঐক্যের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

এই বিভক্তির ফলশ্রুতিতে মাওয়ারাউননাহরে এক নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটে—যাকে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য বলা হয়। এই সাম্রাজ্য প্রায় এক শতাব্দী মঙ্গোল আক্রমণের মোকাবিলা করেছিল। খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পাশাপাশি ইরাক ও শামের উত্তরাঞ্চলে সেলজুকদের আরেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, যাকে ‘আতাবক’ নামে চিহ্নিত করা হয়।

এসময় রোম সালজুকী সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ সাম্রাজ্য ক্রুসেডার আক্রমণ প্রতিহত করে আনাতোলিয়ার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলকে শত্রু সেনাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু মঙ্গোল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত লুণ্ঠনকারীদের হাতে ধ্বংস হয়ে যায়।

সেলজুক সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে বহু কারণ ছিল, যা আব্বাসী খিলাফতের পতনের পথও সুগম করেছিল।

সেলজুক সাম্রাজ্যের পতনের কারণসমূহ:
১. সেলজুক পরিবারে ভাই, ভাতিজা ও পৌত্রদের মধ্যে সিংহাসনের জন্য যুদ্ধ।
২. কিছু আমির, মন্ত্রী ও শিক্ষকের প্ররোচনায় শাসকদের মধ্যে ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা।
৩. শাসনকার্যে নারীদের হস্তক্ষেপ।
৪. আব্বাসী খিলাফতের পক্ষ থেকে সেলজুক সামরিক শক্তির সামনে দুর্বলতা প্রকাশ এবং প্রত্যেক শক্তিশালী সেলজুক সুলতানকে স্বাধীনভাবে শাসন করার অনুমোদন দেওয়া, খুতবায় তাদের নাম উচ্চারণের অনুমতি দেওয়া এবং এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন না করা।
৫. আব্বাসী খিলাফতের অধীনে শাম, মিসর ও ইরাকে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সেলজুকদের ব্যর্থতা।
৬. সেলজুকদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, যা শক্তি ক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং অবশেষে ইরাকেও তাদের শাসন অবসান ঘটে।

অভ্যন্তরীণ বিভাজন ছাড়াও, বাতিনী (ইসমাইলি) সম্প্রদায়ভুক্ত হাসান ইবন সাবাহর ষড়যন্ত্র, যারা গোপনে আন্দোলন চালিয়ে আলেম, মন্ত্রী, রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব ও মুসলিম সমাজের বিশিষ্টদের হত্যা করত; বাইরের দিক থেকে ক্রুসেডার বাহিনীর আগমন এবং ইউরোপীয় বর্বর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধও সেলজুক সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তবে এই কথাও উপেক্ষা করা চলে না যে, সেলজুকরা তাদের শাসনামলে বহু মহান সাফল্য অর্জন করেছিল। যেমন—

১. সেলজুক সাম্রাজ্যের কারণে আব্বাসী খিলাফতের পতন প্রায় দুই শতাব্দী বিলম্বে হয়। যদি সেলজুকরা না থাকত, তবে শিয়া ও রাওয়াফিযের হাতে আব্বাসী খিলাফত বহুকাল আগে ধ্বংস হয়ে যেত।
২. মিসরে উবাইদি (ফাতেমীয়) সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সেলজুক শক্তির কারণে পূর্বাঞ্চলের আরব মুসলিমরা এই বিদেশি রাওয়াফিযের শাসন গ্রহণ করেনি এবং তাদের নোংরা অভিপ্রায় পূর্ণ হয়নি।
৩. সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রচেষ্টা ছিল পূর্ব ইসলামী জগতে ঐক্যের সূচনা, যা সুনির্দিষ্ট রূপ পায় আব্বাসী পতাকার অধীনে সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহর নেতৃত্বে।
৪. সেলজুকরা তাদের অধীন অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।
৫. বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ক্রুসেডার আক্রমণের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ করে এবং মঙ্গোলদের বিপদও অনেকাংশে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়।
৬. সুন্নি আকীদার দাওয়াত চালু রাখে এবং আলেমদের মর্যাদা উন্নত করে।

এ ছিল সেলজুকদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং ইসলামের সেবায় তাদের অবদানের স্বীকৃতি। অতএব কিছু লোকের ভিত্তিহীন বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া অন্যায় হবে—যেমন অধ্যাপক নাজিব যায়েব তাঁর “আল-মাগরিব ওয়াল আন্দালুস” শিরোনামে বিশ্বকোষে যে মনগড়া কল্পনা আরোপ করেছেন, যেখানে তিনি এ সাহসী মুজাহিদদের চরিত্রহননে কোনো ত্রুটি রাখেননি।

Exit mobile version