তিকরিতের অজানা গল্পগুলি
দাঈশের দখল পরবর্তী সংঘটিত বিভীষণ অপরাধের পর তিকরিত পরিণত হয়েছিল রওয়াফেয শিয়া সম্প্রদায় এবং হাশদুশ শা‘বি বাহিনীর প্রতিহিংসার এক প্রগাঢ় প্রতীকস্থলে। অর্থাৎ এটি সুন্নিদের জন্য ছিল অকল্পনীয় কঠোরতা ও দুর্ভোগের দীর্ঘ অধ্যায়, কেননা রাফেযিরা এই কৌশলগত ও ভূগোলগতভাবে অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্গনটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
দাঈশের পদক্ষেপসমূহ ইরাকের সাধারণ মানবগোষ্ঠীর অন্তরে শত্রুতা, বৈরিতা ও গভীর বিদ্বেষের বিষবীজ বপন করেছিল। কখনো সুন্নি ও রাফেযিদের মধ্যে, কখনো সুন্নি ও ইয়াজিদিদের মধ্যে, কখনো বা সুন্নি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে। দাঈশের এই গভীর কূটকৌশল ফলপ্রসূ হয়েছিল বিভাজনকামী শক্তিগুলোর জন্য।
হাশদুশ শা‘বি ও ইরাকি সরকারি সেনাদলের মাধ্যমে তিকরিত নগরীর দখল ছিল দাঈশ-আধিপত্যাধীন অঞ্চলসমূহের বিরুদ্ধে আরম্ভকৃত ব্যাপক সামরিক অভিযানের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। যদিও বাহ্যত এই অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল তিকরিতকে দাঈশের পঞ্জর থেকে মুক্ত করা, তথাপি শহরের সুন্নি অধিবাসীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের অবমাননা, অমানবিক নিপীড়ন, নৃশংস অপরাধ এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধের বিবিধ নিদর্শন প্রামাণ্য গ্রন্থাবলিতে নিবন্ধিত হয়ে আছে।
ইরাকের নানাস্থানে দাঈশের পরাজয়ের পর সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতি যে আচরণ সংঘটিত হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে এক মহাবিপর্যয় এবং ক্ষমার অতীত এক নিষ্ঠুরতা। আমরা সুন্নিদের উপর সংঘটিত এই নিপীড়নের দায়ভার রাফেযিদের উপর আরোপ করি না; বরং এই অবমানবিক ঘটনার প্রকৃত অপরাধী হচ্ছে দাঈশের সমর্থক ও ইবনু মুলজিমের অনুসারীস্বরূপ ব্যক্তিরা।
এই প্রসঙ্গে আমরা নিম্নে ইতিহাস-সঞ্জাত ও বিশ্লেষণসমৃদ্ধ এক নিবিড় পর্যালোচনা নিবেদন করছি—
১. তিকরিত দখলের পটভূমি
২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জুনে দাঈশ দ্রুতগতিতে মসুল ও তিকরিতের মতো বৃহত্তর নগরীগুলো গ্রাস করার পর ইরাকি সরকার, ইরানের প্ররোচনা ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত শিয়া মিলিশিয়া হাশদুশ শা‘বির সহায়তায়, সেই সব অঞ্চল পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে মহাযজ্ঞ আরম্ভ করে।
তিকরিত পুনর্দখলের এই অভিযান সূচিত হয় ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে হাশদুশ শা‘বি, ইরাকি সেনাবাহিনী এবং বহিঃদেশীয় ও মার্কিন উপদেষ্টাদের বিস্তৃত অংশগ্রহণে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিকরিত দাঈশের কবল থেকে উদ্ধারলাভ করে।
২. তিকরিত দখলের পর হাশদুশ শা‘বির নৃশংসতা ও অপরাধ
দাঈশ যখন তিকরিত থেকে বিতাড়িত হয়, হাশদুশ শা‘বির সৈন্যদল নগরীতে প্রবেশ করে এবং সুন্নি অধিবাসীদের বিরুদ্ধে বিস্তৃত প্রতিশোধপরায়ণ কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, যা নিম্নরূপ—
ক) মৃত্যুদণ্ড ও সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ:
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাক্ষ্য অনুযায়ী, অসংখ্য সুন্নি নাগরিককে অবৈধভাবে বন্দী করা হয়, অকথ্য নির্যাতনের শিকার করা হয় এবং অবশেষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তিকরিত-অধস্তন অঞ্চলে অসংখ্য সুন্নিকে “দাঈশের সহায়ক” আখ্যায় আখ্যায়িত করে কোনো প্রকার বিচারের তোয়াক্কা না করেই হত্যা করা হয়, যদিও তাদের অধিকাংশের সঙ্গে দাঈশের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না।
খ) গৃহ-অগ্নিসংযোগ ও লুন্ঠন:
শতশত সুন্নি পরিবারের আবাসন অগ্নিসংযোগে কিংবা বিস্ফোরণের বিভীষিকায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, গৃহস্থালি সামগ্রী, যানবাহন, বাজার এবং এমনকি মসজিদসমূহও হাশ্দুশ শা‘বির সেনাদলের লুণ্ঠনদীপ্ত গ্রাসে নিঃশেষিত হয়।
গ) সুন্নি মসজিদে অগ্নিসংযোগ:
বহু নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, তাকরিত ও এর প্রান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে বহু সুন্নি মসজিদ অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত বা বিস্ফোরণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই ঘটনাগুলো প্রকাশ করে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি, যার লক্ষ্য ছিল সুন্নি ধর্মানুশীলীদের সন্ত্রস্ত ও উদ্বাস্তু করে তোলা।
ঘ) বাস্তুচ্যুতদের প্রত্যাবর্তনে বাধা:
অভিযানের সমাপ্তি-পর্বে বহু সুন্নি পরিবারকে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি প্রদানে বিরত রাখা হয়; হাশ্দুশ শা‘বির নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলসমূহ কার্যত সুন্নিদের জন্য নিষিদ্ধ প্রাচীর ও কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে পরিণত হয়।
৩. হাশদুশ শা‘বির অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
দেশীয় স্তরে কিছু ইরাকি সুন্নি রাজনীতিবিদ, যেমন উসামা আন নুজাইফি—এসব কর্মকাণ্ডের প্রতি তীব্র ধিক্কার উচ্চারণ করেন। ইরাকি জাতীয় সংসদে হাশদুশ শা‘বির সেনানায়কদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও শিয়া বাহিনীর প্রভাবশালী কর্তৃত্বের কারণে কোনো গুরত্বপূর্ণ অনুসন্ধান অগ্রসর হয়নি।
আন্তর্জাতিক স্তরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসমূহ স্বাধীন অনুসন্ধানের প্রস্তাব পেশ করলেও ইরাকি সরকার অনেক সময় এসব প্রতিবেদন অগ্রাহ্য করেছে, কখনো বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, এবং প্রায় সর্বত্র স্বাধীন অনুসন্ধানের উদ্যোগে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।
৪. সার্বিক বিশ্লেষণ
হাশদুশ শা‘বির মাধ্যমে তাকরিতের দখল সুস্পষ্ট করে তোলে যে দাঈশবিরোধী অভিযান কেমন করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়েছিল। নাগরিক অধিকার রক্ষা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সংঘটিত হয়েছিল এমন ভয়াল কার্যক্রম, যা ধর্মীয় বিভাজনকে প্রগাঢ়তর করেছে এবং সুন্নিদের কেন্দ্রীয় সরকারপ্রতি আস্থা নিঃশেষ করে দিয়েছে।
এই সব অপরাধ কিছু সুন্নি তরুণের জন্য আবারও উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়া ও প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনসমূহে অংশগ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত করেছে। সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে সরকারের বৈধতা তীব্রভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বহু বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে, এই ঘটনাসমূহ ইরাকের ধর্মীয় সহিংসতার দীর্ঘস্থায়ী ধারাবাহিকতার এক মৌলিক কারণ হিসেবে বিবেচ্য।