ইরাকের আনবার প্রদেশে অবস্থিত ফালুজাহ শহর, ২০০৩ সালে পশ্চিমা শক্তির ইরাক দখলের পর থেকে ইরাকি জনতার জিহাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ প্রতীকে পরিণত হয়। সুন্নি মতাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এ নগরী দ্রুতই মার্কিন দখলদার বাহিনী ও জিহাদি সংগঠনগুলোর মধ্যকার তীব্র সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
ফালুজাহর প্রতিরোধ শুধু এ শহরের জনগণের অটলতার সাক্ষ্য হয়ে থাকেনি, বরং ইরাক তথা সমগ্র ইসলামী বিশ্বের জন্যও হয়ে উঠেছিল এক প্রেরণার দৃষ্টান্ত। ফালুজাহ প্রসঙ্গে মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে এর ভৌগোলিক ও কৌশলগত গুরুত্ব উল্লেখ করা জরুরি। ফালুজাহ বাগদাদ থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, বাগদাদ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী প্রধান সড়কে অবস্থিত।
এই ভৌগোলিক অবস্থান ফালুজাহকে সামরিক ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত করেছিল। তদুপরি, সৌদি আরব ও জর্ডানের সীমানার নিকটবর্তী হওয়ায় এটি মার্কিন বাহিনীর কাছে বিশেষ কৌশলগত তাৎপর্য বহন করত।
ফালুজাহতে প্রতিরোধের সূচনা
দখলদারিত্বের প্রাথমিক দিনগুলোতেই ফালুজাহ ছিল ইরাকের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অধিক অস্থির। জিহাদের প্রথম স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত হয় তখনই, যখন মার্কিন সেনারা শহরে প্রবেশ করে ঘরে ঘরে তল্লাশি, নির্বিচারে গ্রেফতার, এবং ইসলামী পবিত্রতার অবমাননা শুরু করে। যে ঘটনা জনতার ক্ষোভকে চরমে পৌঁছে দেয়, তা ঘটে ২০০৩ সালের এপ্রিলে।
মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে ফালুজাহবাসী যে বিক্ষোভ শুরু করেছিল, সেই সময় মার্কিন সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে বহুজনকে শহীদ করে। এই ঘটনা ফালুজাহতে সশস্ত্র প্রতিরোধের সূচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত হয়।
ফালুজাহর যুদ্ধসমূহ: মুসলিমদের জন্য রক্তাক্ত অধ্যায়
(ক) ফালুজাহর প্রথম যুদ্ধ (এপ্রিল ২০০৪)
ব্ল্যাকওয়াটার কোম্পানির চারজন মার্কিন কন্ট্রাক্টর ফালুজাহতে নিহত হয়ে তাদের মৃতদেহ জনতা দ্বারা দগ্ধ হওয়ার পর, মার্কিন সেনারা শহর সম্পূর্ণ দখলের উদ্দেশ্যে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের পরও স্থানীয় গোত্র, মুজাহিদীন এবং এমনকি সদ্দাম হুসাইনের অনুগত সেনারা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এই প্রতিরোধ মার্কিন সেনাদের পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে এবং তারা শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা পেন্টাগনের জন্য রাজনৈতিক লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
(খ) ফালুজাহর দ্বিতীয় যুদ্ধ (নভেম্বর ২০০৪)
নভেম্বর ২০০৪-এ, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন গঠিত ইরাকি ক্রীতদাস বাহিনীর সহযোগিতায় “ফাজরুল গাদাব” নামের আরেকটি অভিযান শুরু করে। এবার ছিল আরও ভয়াবহ; তীব্র বিমান হামলা, সাদা ফসফরাসের মতো নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার, এবং শহরের সম্পূর্ণ অবরোধের মাধ্যমে মার্কিন সেনারা শহরের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়—কিন্তু এর বিনিময়ে ভয়াবহ মানবিক মূল্য চুকাতে হয়।
কিছু অনুমান অনুসারে, এ অভিযানে আড়াই হাজারেরও বেশি সাধারণ নাগরিক এবং হাজারো সুন্নি মুজাহিদ শহীদ হন। এই যুদ্ধে ফালুজাহ প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়, তবুও তা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে অটুট থাকে।
ফালুজাহর প্রতিরোধের প্রকৃতি
ফালুজাহতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল নানাবিধ শক্তি—
• স্থানীয় গোত্র, যারা ধর্মীয় ও জাতীয় মর্যাদাবোধে উজ্জীবিত হয়ে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অটল ছিল।
• ইসলামী সংগঠন, যেমন—ইরাকে আল কায়েদা (সেই সময়ে আবু মুসআব আয জারকাওয়ী রহ -এর নেতৃত্বে), যারা মুজাহিদীনের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং বহু তরুণকে তাদের কাতারে যুক্ত করে।
• সদ্দাম হুসাইনের অনুগত সেনারা, যারা ক্ষমতা হারানোর প্রতিশোধে দখলদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়।
যদিও এদের মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য ছিল, তথাপি ফালুজাহতে তারা একক লক্ষ্যে দখলদারদের প্রতিরোধে একত্রিত হয়েছিল।