খাওয়ারিজরা এক মতবাদ-নির্ভর আদর্শিক সম্প্রদায়, যাদের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় রক্তক্ষয়ী মতানৈক্যমূলক সংঘাতে রঞ্জিত। ইসলামের প্রভাতযুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত এদের চিন্তাধারা বিভিন্ন উগ্রপন্থী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আধুনিক দুনিয়ায় তথাকথিত দাঈশের মতাদর্শেও খারিজি মানসিকতার গভীর প্রভাব প্রতিফলিত হয়।
খুরূজ (الخروج) ও খাওয়ারিজ (الخوارج)–এর সংজ্ঞার ভাষ্যে বিশিষ্টজনের দৃষ্টিভঙ্গি
খুরূজ (الخروج): শাব্দিক অর্থ প্রস্থান, বের হওয়া, বিদ্রোহ করা। পরিভাষায়, মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে বিদ্রোহ করাকে “খুরূজ” বলা হয়।
খাওয়ারিজ (الخوارج): “খুরূজ”–এর বহুবচন, অর্থ বিদ্রোহীরা। ইসলামের ইতিহাসে, তারা সেই গোষ্ঠী যারা চতুর্থ খলিফা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং চরমপন্থী মতবাদ গ্রহণ করে।
১. ইমাম শাফেয়ী (رحمه الله):
”الخوارج هم الذين يعتمدون على تفسير القرآن والسنة تفسيراً متشدداً بغير دليل، مما يؤدي إلى تفريق وحدة الأمة الإسلامية.“
অর্থ: খারিজিরা সেই সম্প্রদায়, যারা কোনো গ্রহণযোগ্য দলিল বা ব্যাখ্যাগত অনুমোদন ব্যতিরেকে কুরআন ও সুন্নাহকে কঠোরভাবে ব্যাখ্যা করে এবং যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বিদীর্ণ হয়।
—
২. আল্লামা আবুল হাসান আশ’আরী (رحمه الله):
”الخوارج هم الذين يكفرون المسلمين بالذنوب والمعاصي، ويرون وجوب الخروج على أئمة المسلمين إذا وقعوا في الذنب.“
অর্থ: খারিজিরা সেই গোষ্ঠী, যারা পাপ ও গুনাহকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বিচ্যুতির মানদণ্ডরূপে বিবেচনা করে এবং এই যুক্তিতে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সশস্ত্র প্রতিরোধকে আবশ্যক মনে করে।
—
৩. ইতিহাসবিদ ও মুফাসসির ইবনুল আসীর (رحمه الله):
”الخوارج فرقة ظهرت في التاريخ الإسلامي، قامت بتكفير المسلمين والخروج على الحكام بسبب تأويلاتهم المتشددة.“
(الكامل في التاريخ)
অর্থ: খারিজিরা ইসলামের ইতিহাসে এমন এক গোষ্ঠী, যারা তাদের কঠোর ব্যাখ্যা ও যুক্তিকাঠামোর ওপর নির্ভর করে মুসলিমদের ওপর কুফরের ফতোয়া জারি করেছে এবং শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে।
—
৪. আল্লামা শাহরিস্তানী (رحمه الله):
”كل من خرج على الإمام الحق الذي اتفقت عليه الأمة يسمى خارجياً، سواء كان ذلك في عهد الخلفاء الراشدين أو بعدهم.“
(الملل والنحل)
অর্থ: যে-ই ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহ কর্তৃক স্বীকৃত ন্যায়সঙ্গত ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সে-ই খারিজি বলে অভিহিত হবে, তা সে খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে হোক বা তৎপরবর্তী সময়ে হোক।
—
খাওয়ারিজ মতাদর্শের মূল উপাদান
শাস্ত্রবিদগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, যে ব্যক্তি খারিজিদের চিন্তাধারা ধারণ করে কিংবা তাদের কার্যকলাপ অনুসরণ করে, সে-ই তাদের অন্তর্ভুক্ত। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো তাদের অন্যতম নীতি:
تحكيم (তাহকীম) প্রত্যাখ্যান:
সালিশ গ্রহণ ও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কুরআনি নীতির বিপরীতে অবস্থান।
تكفير بالكبائر (কবিরাহ গুনাহের কারণে তাকফির):
যারা কবিরাহ গুনাহে লিপ্ত হয়, তাদের ইসলামের গণ্ডির বাইরে গণ্য করা।
الخروج على الحكام (শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ):
শাসকের সীমালঙ্ঘনের কারণে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা বাধ্যতামূলক মনে করা।
الخلود في النار (চিরস্থায়ী জাহান্নামের বিশ্বাস):
কবিরাহ গুনাহকারীদের অনন্তকালের জন্য জাহান্নামী মনে করা ও অভিশাপ দেয়া।
—
”الخوارج“ (খারিজি) শব্দের প্রেক্ষিতে
১. ইতিবাচক প্রেক্ষাপট:
যদি “খারিজি” শব্দটি নিচের বরকতময় আয়াত থেকে গৃহীত হয়—
”وَمَن يَخْرُجْ مِن بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ“
(سورة النساء: 100)
অর্থ: “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হিজরত করার উদ্দেশ্যে তার ঘর থেকে বের হয়, অতঃপর মৃত্যুবরণ করে, তবে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে অবশ্যই নির্ধারিত।”— তবে এই নামটি প্রশংসনীয় অর্থ বহন করবে। খারিজিরা নিজেদের কার্যকলাপের বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই শব্দের এমন ব্যাখ্যা প্রচার করেছিল।
২. নেতিবাচক প্রেক্ষাপট:
কিন্তু যদি এই নামটি রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতা ও ইসলামী শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করার প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি নিঃসন্দেহে নিন্দাসূচক হবে। অধিকাংশ শাস্ত্রবিদ এই অর্থেই “খারিজি” শব্দের ব্যবহার করেছেন।
—
খারিজিদের সম্পর্কে হাদিসসমূহ
“ফাতহুল বারী”–তে রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর খারিজিদের সম্পর্কে একাধিক সতর্কবার্তা সংকলিত হয়েছে।
১. উম্মুল মুমিনীন আয়িশাহ (رضي الله عنها) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
”هُم شِرَارُ أُمَّتِي، يَقتُلُهُم خِيَارُ أُمَّتِي.“
(البزار)
অর্থ: “তারা আমার উম্মতের নিকৃষ্টতম লোক, আর আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিরা তাদের হত্যা করবে।”
—
২. আবদুল্লাহ ইবনু আবি আওফা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“الخوارج كلاب النار.”
(ابن الجوزي)
অর্থ: “খারিজিরা জাহান্নামের কুকুর।”
চলবে…