খারিজিদের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড
যেমনটি ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, খারিজিরা চরমপন্থার ভিত্তিতে তাদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছিল এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তাদের বিপ্লবী আন্দোলন ছিল সর্বদাই নিষ্ঠুর ও রক্তক্ষয়ী। এই ধারাবাহিকতা সূচিত হয়েছিল মুহাক্কিমা গোষ্ঠীর বিদ্রোহের মাধ্যমে, যারা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল।
পরবর্তী কালে এই বিদ্রোহী দলসমূহ আরও ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালায় এবং পরবর্তীকালে উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধারণ করে।
৬৪ হিজরিতে নাফি’ ইবনুল আজরাকের নেতৃত্বে খাওয়ারিজরা বহু শাখায় বিভক্ত হয়, যা আব্বাসীয় খেলাফতের সূচনা পর্যন্ত টিকে ছিল। আধুনিক পরিভাষায়, খাওয়ারিজদেরকে একপ্রকার “বিরোধী আন্দোলন” হিসেবেও চিত্রিত করা যায়, যাদের সংগ্রামের বিবরণ ইতিহাসের দলিলসমূহে এবং বিভিন্ন মতবাদবিষয়ক গ্রন্থসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে।
—
খাওয়ারিজদের উপদল (ফেরকা) ও তাদের বিভাজন
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুসলিম উম্মাহর প্রতি অনুগ্রহস্বরূপ খারিজিদের মধ্যে মতাদর্শগত বিভেদ সৃষ্টি করেছিলেন। যদি তারা এককাট্টা থাকত, তবে মুসলিম সমাজের জন্য তারা এক ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াত। তাদের বিভক্তির প্রধান কারণ ছিল তাদের উগ্র মতবাদ, যা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিত।
যেমন, নাফি’ ইবনুল আজরাক যখন তাকিয়্যা (আকীদা গোপন করা) ও তার প্রতিপক্ষদের সন্তানদের বিষয়ে কঠোর বিধান প্রবর্তন করল, তখন তার দলের অভ্যন্তরেই মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে নতুন নতুন উপদলের উদ্ভব ঘটে, এবং তাদের মধ্যে ক্রমাগত বিভাজন চলতে থাকে।
সময়ের প্রবাহে তাদের অনেক দল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিছু দল একে অপরের সঙ্গে একীভূত হয়েছে, আবার কেউ কেউ তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছে।
—
খারিজি ফেরকার সংখ্যা: এক ঐতিহাসিক রহস্য
ইসলামী পণ্ডিতগণ খারিজিদের ফেরকার সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
ইমাম আবুল হাসান আল-আশআরি রাহিমাহুল্লাহ তাদের চারটি প্রধান উপদলে বিভক্ত করেছেন।
অপর কিছু গবেষক তাদের পাঁচ, সাত কিংবা পঁচিশটি উপদলে বিভক্ত করেছেন।
কিছু ঐতিহাসিকের মতে তাদের প্রকৃত সংখ্যা আরও অধিক ছিল।
খারিজি ফেরকার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা চিহ্নিত করা দুরূহ কারণ—
১. তাদের অস্থিতিশীলতা: খারিজিরা সংঘাত ও রাজনীতির প্রবাহে ক্রমাগত পরিবর্তিত হতো এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ত।
২. তুচ্ছ মতপার্থক্যে বিচ্ছিন্নতা: খারিজিদের মধ্যে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও বিরোধ দেখা দিত, যার ফলে তাদের মাঝে একের পর এক নতুন উপদলের জন্ম হতো।
৩. তাদের গোপনীয় নীতি: নিজেদের মতাদর্শ রক্ষা এবং শত্রুর নিকট প্রকাশ না করার মানসে তারা বহু গুরুত্বপূর্ণ লিখিত দলিল গোপন রেখেছিল, যার ফলে তাদের বিশ্বাস ও ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য সংরক্ষণ দুষ্কর হয়ে ওঠে।
—
ইবাদিয়া ফেরকা: টিকে থাকা একমাত্র খারিজি সম্প্রদায়
খারিজিদের মধ্যে একমাত্র টিকে থাকা উপদল হলো ইবাদিয়া সম্প্রদায়, যার অনুসারীরা আজও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান। তাদের রাজনৈতিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি স্বতন্ত্র গবেষণার দাবিদার।
—
ইবাদিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ও তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার
ইবাদিয়ারা তাদের চিন্তাধারার সূত্রপাত জাবির ইবনু যায়েদ আল-আজদির মধ্যে খুঁজে পায়, যিনি হযরত ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর অন্যতম ছাত্র ছিলেন। তবে, তাদের সম্প্রদায়ের নামকরণ আবদুল্লাহ ইবন ইবাদের নামানুসারে হয়েছে, যিনি শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলেন।
আবদুল্লাহ ইবন ইবাদ ছিলেন বানু তামীম গোত্রের অন্যতম ব্যক্তি এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগের তাবিঈদের মধ্যে গণ্য হন।
—
ইবাদিয়াদের দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিগণ
খারিজিরা সাধারণত হযরত আবু বকর ও হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিল। তবে, হযরত উসমান ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমার প্রতি তারা ঘৃণাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করেছিল, এবং তাদের সম্পর্কে এমন কিছু বক্তব্য প্রদান করেছিল, যা থেকে আল্লাহ তাআলা তাদের মুক্ত রেখেছেন।
ত্বালহা ও যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার বিরুদ্ধেও তারা কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল, যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
“আমার সাহাবিদের সম্পর্কে কটূক্তি করো না। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন, যদি তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও দান করে, তবু তা আমার সাহাবিদের এক মুষ্টি খাদ্যের সমতুল্যও হবে না, বরং তার অর্ধেকের সমানও হবে না।”
এখন প্রশ্ন হলো— যদি এই সম্প্রদায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠতম সাহাবিদের মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে তারা আদৌ কাকে সম্মানিত গণ্য করে?