খাওয়ারিজদের পরিচয় | অষ্টম পর্ব

✍🏻 রাশেদ শফীক

সামগ্রিক ইমামত সম্পর্কে খাওয়ারিজদের আকীদা
খারিজিদের আবির্ভাবের সূচনা থেকে শুরু করে উমাইয়াহ ও আব্বাসী খিলাফতের প্রথম দিকের বছরগুলো পর্যন্ত তাদের প্রধান বিতর্কের বিষয় ছিল নেতৃত্ব। তারা মূলত শাসকের বিরুদ্ধাচারণ করত এই যুক্তিতে যে, তাদের নিজস্ব ইমাম নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়নি। সেই সঙ্গে তারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিতেও অসন্তুষ্ট ছিল।

তারা ইমামের ব্যক্তিত্ব, গুণাবলি ও সামাজিক ভূমিকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তৎপর ছিল। কিন্তু যখন নেতৃত্ব গ্রহণের প্রশ্ন এসেছে, তখন তারা ক্ষমতা লাভের পরিবর্তে নিজেদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছে।

ইমামতের বিষয়ে খাওয়ারিজদের মতবাদ
ইমামত ইসলামের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান, যা সমাজের স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে। জনগণের মধ্যে ঐক্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ সংরক্ষণে একজন সঠিক নেতা অপরিহার্য। তবে খারিজিরা এ বিষয়ে দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

প্রথম দল:
এই গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ খারিজিদের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা ইমামের নির্বাচনকে আবশ্যিক মনে করে এবং বিশ্বাস করে যে, ইমামের আনুগত্য করা অবশ্যকর্তব্য। তবে যদি ইমাম তাদের দৃষ্টিতে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়, তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

দ্বিতীয় দল:
এটি খারিজিদের মধ্যে ‘মুহাকিমাহ’, ‘নাজদাত’ এবং কিছু ‘ইবাদিয়া’ গোষ্ঠীর আকীদা, যারা মনে করে যে, যদি জনগণ নিজেদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে তবে ইমামের প্রয়োজন নেই। তবে যদি প্রয়োজন হয়, তবে যেকোনো জাতি থেকে যোগ্য ব্যক্তি ইমাম হতে পারে।

তাদের যুক্তিসমূহ:
১. তারা “لَا حُکْمَ إِلَّا لِلَّهِ” (সর্বময় কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর) এই আয়াতকে যুক্তি হিসেবে পেশ করে, যা তাদের মতে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে।
২. তাদের মতে শাসনকর্তৃত্ব মানুষের কাজ নয়, বরং এটি একমাত্র আল্লাহর বিশেষ এখতিয়ার।
৩. শাসনের মূল উদ্দেশ্য শরীয়তের বাস্তবায়ন, আর যদি জনগণ নিজেরাই তা করতে পারে, তবে ইমামের প্রয়োজন নেই।
৪. ইমাম এমনও হতে পারেন, যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে অবস্থান করেন, ফলে তার অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পড়ে।
৫. রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজ হাতে তাঁর পরে আসা খলিফাদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা দেননি।
৬. কুরআনে কোথাও স্থায়ী ইমামতের উল্লেখ নেই, বরং বলা হয়েছে: “وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ” (তাদের কার্যাবলি পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়)।

তবে, তারা কি এই মতবাদে স্থির ছিল?
না, বাস্তবে তারা নিজেদের এই আদর্শ ধরে রাখতে পারেনি। ‘মুহাকিমাহ’ গোষ্ঠী নির্বাসিত হওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবন ওয়াহহাব আর-রাসিবীকে নেতা হিসেবে বেছে নেয়। ‘নাজদাত’ গোষ্ঠী নিপীড়িত হওয়ার পর নজদা ইবন আমিরকে তাদের নেতা বানায়। আর ‘ইবাদিয়া’ গোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা ইমাম নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে। কিন্তু তাদের নিজস্ব উৎসে এর বিপরীত প্রমাণ পাওয়া যায়, যা তাদের শত্রুরা তাদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছে।

খারিজিদের মতে ইমাম নির্বাচনের শর্তাবলি:
১. ইমাম হতে হলে ইসলামী আকীদায় অবিচল, নিষ্ঠাবান ও তাকওয়াবান হতে হবে।
২. তার চরিত্র উন্নত হতে হবে, দৃঢ় মনোবল, সুদৃঢ় চিন্তাশক্তি ও সংকল্প থাকতে হবে।
৩. তিনি গুনাহ ও নিরর্থক কর্মকাণ্ডে আসক্ত হবেন না।
৪. যদি কেউ গুনাহে লিপ্ত হয়, তবে তওবা করলেও সে ইমাম হতে পারবে না।
৫. ইমামের নির্বাচন সকল মুসলিমের সম্মতিক্রমে হতে হবে, কয়েকজন ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিলে তা বৈধ হবে না।

তারা মুখে বলত যে, ইমাম নির্বাচনে বংশ ও গোত্রের প্রাধান্য নেই। কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেদের স্বার্থের ভিত্তিতে এই নীতি প্রয়োগ করত। তারা দাবি করত যে, ইমাম নির্বাচনের দায়িত্ব ‘আহলুল হাল ওয়াল আক্বদ’ (সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কাউন্সিল) এর উপর বর্তায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটি কোনো নতুন নীতি ছিল না; বরং ইসলামী শাসনব্যবস্থার একটি প্রচলিত ও স্বীকৃত রীতি।

তারা “الخلافة في قريش” (খিলাফত কুরাইশদের অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ) – এই সহিহ হাদিসকে অগ্রাহ্য করে এবং খিলাফতের জন্য কুরাইশি বংশের শর্তকে প্রত্যাখ্যান করে।

অযোগ্য ব্যক্তিকে ইমাম করার প্রশ্ন:
খাওয়ারিজদের মধ্যে মতভেদ ছিল যে, যদি সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকে, তাহলে তার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে ইমাম করা যাবে কি না?

১. অনেক খারিজি গোষ্ঠী এটি অস্বীকার করে এবং বলে যে, নেতৃত্ব কেবলমাত্র যোগ্যতম ব্যক্তির প্রাপ্য।
২. অপরদিকে কিছু গোষ্ঠী মনে করত যে, যোগ্যতম ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ব্যক্তি ইমাম হতে পারে।

নারীদের ইমামত:
ইমামত এক মহান ও জটিল দায়িত্ব, যার জন্য প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা প্রয়োজন। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, আল্লাহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের গুণাবলি পুরুষদের দিয়েছেন। এ কারণেই ইসলামী শরীয়তে নারীকে খিলাফতের দায়িত্ব প্রদান করা হয়নি এবং সমস্ত ইসলামি পণ্ডিত একমত যে, নারীরা খলিফা হতে পারে না।

তবে, খারিজিদের মধ্যে “শাবিবিয়া” নামক একটি উপদল নারীদের ইমামতকে বৈধ বলে মনে করত। তাদের যুক্তি ছিল, শাবিবের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী (বা কিছু সূত্র মতে, তার মা) গাযালাকে তাদের নেত্রী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল।

Exit mobile version