২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার। দুপুরের দ্বিতীয় প্রহর। জুমার নামায সমাপ্তির পর মাওলানা হামিদুল হক মুসল্লিদের স্রোত পার হয়ে মসজিদের সেই দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, যা ওলামা ও শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। যখন তিনি দোরগোড়ায় পৌঁছালেন, তখন এক আত্মঘাতী হামলাকারী দুর্বার গতিতে তার দিকে ধাবিত হয় এবং মুহূর্তের ব্যবধানে বিস্ফোরক-বোঝাই জ্যাকেটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, মাওলানা হামিদুল হক প্রথমে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহাদত বরণ করেন। এই বর্বরোচিত হামলা সংঘটিত হয়েছিল খাইবার পাখতুনখোয়ার নওশেরা জেলার আকোড়া খাটকের জামিয়া হাক্কানিয়া মাদরাসার প্রধান মসজিদে। এক পবিত্র ময়দান, যেখানে প্রতি শুক্রবার হাজারো মুসল্লি, ছাত্র ও সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়।
এই হত্যাকাণ্ড কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশ, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মাওলানা হামিদুল হককে পূর্বেই সতর্ক করেছিল যে, তিনি সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়— যদি হুমকির তথ্য আগেই ছিল, তবে এই হামলা প্রতিরোধে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? কেন কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি? এর উত্তর আজও অজানা।
মাওলানা হামিদুল হক শুধু জামিয়া হাক্কানিয়ার উপ-মহাপরিচালকই ছিলেন না, বরং তিনি পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (সামি)-এর প্রধানও ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, যদি হামলার লক্ষ্য কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা হতেন— ধরা যাক, মুসলিম লীগ (ন) বা পাকিস্তান পিপলস পার্টির কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তি; তাহলে কি পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কেবলমাত্র ‘সতর্কবার্তা’ দিয়েই ক্ষান্ত থাকত? নাকি হামলাকারীকে প্রতিহত করতে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করত?
এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাদের সুরক্ষায় মনোযোগী, আর কাদের নিরাপত্তা কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতার খোলসে আবদ্ধ। তাদের কৌশল বরাবরই এক—
১. কেবল হুমকির সতর্কবার্তা প্রদান করা;
২. প্রতীকী নিরাপত্তার নামে কিছু পুলিশ সদস্য নিযুক্ত করা (যারা নিজেরাই অসহায়);
৩. সম্ভাব্য হামলাকারীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা এবং তাকে লক্ষ্যে পৌঁছার সুযোগ করে দেওয়া।
এই ‘সতর্কবার্তা’ ও দায়সারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা মূলত নিজেদের দায়মুক্তির কৌশল ছাড়া কিছুই নয়, যা সচেতন জনগণ সহজেই বুঝতে পারে। পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোর বোঝা উচিত এই কৌশল আর কার্যকর নয়।
কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শী প্রতিক্রিয়া
হামলার দুই দিন পর, খাইবার পাখতুনখোয়ার সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা (CTD) এক গণবিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে নিহত আত্মঘাতী হামলাকারীর ছবি সংযুক্ত করে ঘোষণা দেওয়া হয়—
“যদি কোনো ব্যক্তি এই হামলাকারীর পরিচয়, পিতার নাম ও ঠিকানা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করেন, তবে তাকে পাঁচ লক্ষ রুপি পুরস্কার প্রদান করা হবে, এবং তথ্যদাতার নাম গোপন রাখা হবে।”
এটি ছিল পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার এক হাস্যকর ও অপেশাদার প্রতিক্রিয়া একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে! এই উদাসীনতা প্রমাণ করে যে হয় এসব প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ অকার্যকর, নতুবা তারা জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার একটি পরিকল্পিত খেলা খেলছে।
এমনকি, পাকিস্তানে যখনই কোনো নৃশংস ঘটনা ঘটে এবং রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে তার যথাযথ ব্যাখ্যা থাকে না, তখনই তারা দায় এড়ানোর জন্য পুরোনো ছক ব্যবহার করে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া।
এই ঘটনার পরও সেই একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টগুলো প্রথমে প্রচার করতে শুরু করে যে, হামলাকারী আফগান নাগরিক ছিল এবং এ ঘটনাকে আফগান শরণার্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। পরে তারা আফগানিস্তানের সরকারের ওপর এই হত্যাকাণ্ডের দায় চাপানোর প্রয়াস চালায়।
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সংবাদ চ্যানেলগুলো তাদের সংবাদে কৌশলে এই লাইন যুক্ত করে দেয়— “মাওলানা হামিদুল হক নারীদের শিক্ষার পক্ষে ছিলেন”, যাতে তার হত্যাকাণ্ডকে আফগানিস্তানের ইসলামী আমিরাতের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।
এক দীর্ঘকালীন ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর মাওলানা হামিদুল হকের শিষ্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার এক ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি স্পষ্টভাবে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
এটি ভুলে যাওয়া যাবে না যে, মাওলানা হামিদুল হকের পিতা মাওলানা সামিউল হক (রহ.)-কেও ২০১৮ সালে এক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শাহাদত বরণ করতে হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানের অন্যতম সুরক্ষিত আবাসন প্রকল্প বহরিয়া টাউন, রাওয়ালপিণ্ডিতে, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর অবস্থিত।
মাওলানা সামিউল হক (রহ.) তখন পাকিস্তানি বিচার বিভাগের এক বিতর্কিত রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করছিলেন— বিশেষত সেই রায়, যেখানে ধর্মদ্রোহী আসিয়া বিবিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আয়োজিত জনবিক্ষোভে যোগ দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রাতে, তিনি তার কক্ষে একাধিক ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন। অথচ এটি ছিল এমন এক সংরক্ষিত এলাকা, যেখানে নজরদারির জন্য অসংখ্য সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপিত ছিল।
আজ ছয় বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু মাওলানা সামিউল হকের হত্যার কোনো সুরাহা হয়নি। অন্যান্য হাজারো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মতো এটি কেবল তদন্ত সংস্থার ধুলোমলিন নথির স্তূপে হারিয়ে গেছে।
এবং সন্দেহ নেই যে, মাওলানা হামিদুল হকের হত্যার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটবে। প্রথমে তার পরিবারকে কিছু ভাসা-ভাসা আশ্বাস দেওয়া হবে,
তারপর তদন্তকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হবে,
অবশেষে বিষয়টি জনস্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হবে।
তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রতিক্রিয়া ও পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের ধর্মীয় মহল এই হত্যাকাণ্ডকে সহজে বিস্মৃত হবে না।
এই হামলার পর মাওলানা ফজলুর রহমান মন্তব্য করেছেন—
“এই হামলা আমার ঘর ও মাদরাসার ওপর আঘাত। আমরা বহু বছর ধরে খাইবার পাখতুনখোয়ার নিরাপত্তাহীনতা সম্পর্কে সরব ছিলাম, কিন্তু রাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত।”
চার দিন পর, জামিয়া হাক্কানিয়া এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে যৌথ তদন্ত কমিটি (JIT) গঠনের দাবি জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়—
“যদি পাকিস্তানি সরকার মনে করে যে, মাওলানা হামিদুল হকের হত্যাকাণ্ডকেও ভুলিয়ে দেওয়া হবে, তবে তারা গুরুতর ভুল করছে!”