দাঈশ—যে সংগঠন একসময়ে জনাকীর্ণ বাজারের ভিড়ে খিলাফতের দাবিনামা উঁচিয়ে ধরত, নগর ও জনপদ অধিকার করে রাখত এবং নিজের সামরিক শক্তিকে প্রচন্ড আঘাতের আবহে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরত; আজ সম্পূর্ণ এক রূপান্তরিত সত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ইরাক ও শামভূমিতে যার প্রথম উত্থান, সামরিক পরাজয়ের পর সেই দল এখন এক গোপন, বিস্তৃত এবং জালবোনা নেটওয়ার্কের আকার গ্রহণ করেছে।
দাঈশের বর্তমান কৌশল আর ভূখণ্ড দখলে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এখন তাদের কেন্দ্রবিন্দু ভয় ছড়িয়ে দেওয়া, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা এবং বৌদ্ধিক যুদ্ধক্ষেত্রকে প্রসারিত করা। প্রকাশ্য মোকাবিলার পরিবর্তে তারা এখন অনুপ্রবেশমূলক হামলা, আত্মঘাতী বিস্ফোরণ, লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড এবং গোপন গোয়েন্দা কৌশলের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্যকে অগ্রসর করছে। এই রূপান্তর তাদের একদিকে আড়ালে থাকার সুযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে প্রবল আঘাত হানার সক্ষমতা প্রদান করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে নিয়োগ, উগ্র আদর্শের প্রচারণা, ভিন্নচিন্তার চরিত্রহনন এবং তাদের মতাদর্শিক প্রভাবের বিস্তার—এসবই সেই নতুন সম্মুখযুদ্ধ, যেখানে দাঈশ সর্বশক্তি নিয়ে সক্রিয়। এটি এমন এক লড়াই, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য মানুষের চেতনার রাজ্যে দখল প্রতিষ্ঠা করা।
যদিও উপরিভাগে দাঈশ পরাজিত ও ক্ষয়িষ্ণু বলে প্রতীয়মান, বাস্তবতা হলো প্রতিবারই তারা নতুন পোশাকে, নতুন কৌশলে, অনিরাপত্তা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে আবার উদ্ভাসিত হয়। রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, নৃ-জাতিগত ও ধর্মীয় টানাপোড়েন এবং সামাজিক চাপকে তারা নিজেদের অনুপ্রবেশ, আক্রমণ ও নিয়োগের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে।
এই রূপান্তর স্পষ্ট করে দেয় যে দাঈশ নিঃশেষ হয়নি; তারা কেবল নিজেদের রূপ, অস্ত্র ও কৌশল বদলেছে। অতএব তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কখনোই কেবল সামরিক অভিযানে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না; বরং তা হতে হবে সর্বদিকব্যাপী, বহু-মাত্রিক প্রতিরোধ। এই প্রচেষ্টা হতে হবে বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, গোয়েন্দা এবং গণমাধ্যমিক পরিসরজুড়ে বিস্তৃত।
বৌদ্ধিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে আলেমসমাজ, শিক্ষাবিদ এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের নেতৃত্বে। সমাজমাধ্যমকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা অবশ্যক, যাতে উগ্রতা শিকড় গাঁথতে না পারে। তরুণসমাজকে ধর্মীয় ও জাতীয় সচেতনতায় শিক্ষিত করতে হবে, যাতে তারা এ গোষ্ঠীর ফাঁদে পতিত না হয়। তদুপরি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয় অপরিসীম গুরুত্ববহ, কেননা দাঈশ কোনো আঞ্চলিক সংকট নয়; এ এক বৈশ্বিক হুমকি।
এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমেই আমরা এই গোষ্ঠীকে বৌদ্ধিক, প্রচারণাগত এবং গোয়েন্দা স্তরে আঘাতপ্রাপ্ত করতে পারি এবং তাদের সকল পরিকল্পনাকেই মূলত নিষ্প্রভ ও ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হতে পারি।
