রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুদ্ধজীবন: মানবজাতির জন্য শিক্ষা | পঞ্চদশ পর্ব

✍🏻 আবু রাইয়ান হামিদী

গাযওয়ায়ে বদর থেকে আহরণীয় শিক্ষা
গাযওয়ায়ে বদর ইসলামের সামরিক ইতিহাসে এক দীপ্তিমান ও স্বর্ণাক্ষরে লিখিত অধ্যায়। এই গাযওয়াহ ছিল মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্থানের এক মোক্ষম সূচনাবিন্দু, যা কেবল তাদের আঞ্চলিক মর্যাদাকে সুদৃঢ় করেনি, বরং তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কুরায়েশদের তর্ক ও অবস্থানের ভিতটিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল এবং তাদের নিঃসহায় ও একাকী করে তুলেছিল।

এই গাযওয়াহ অসংখ্য উপদেশ ও ইবরতের অফুরন্ত ভান্ডার, যেগুলোর সুনির্বাচিত উপলব্ধি প্রতিটি মুসলিমের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। বলা যায়, যুদ্ধনীতি ও সশস্ত্র প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উৎস— যেখান থেকে প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির জ্ঞান আহরণ আবশ্যক। এই শিক্ষাসমূহকে অধিকতর সুবিন্যস্তরূপে উপস্থাপন করার নিমিত্তে, লেখাটি দুইটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে।

প্রথম অধ্যায়: গাযওয়ার সূচনা থেকে সম্মুখ সমর অবধি
এই অধ্যায়ে মুসলিম বাহিনীর গমনকাল থেকে যুদ্ধের সূচনালগ্ন পর্যন্ত ঘটনাবলি সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত হবে, যেখানে উম্মতের জন্য বহু মূল্যবান শিক্ষা নিহিত রয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: যুদ্ধ থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত
এই অধ্যায়ে যুদ্ধে প্রবেশের পর থেকে পরিণতি অবধি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র কৌশল ও প্রজ্ঞাপূর্ণ পদক্ষেপ থেকে আহরণীয় শিক্ষাগুলো পর্যালোচিত হবে।

প্রথম অধ্যায়: গাযওয়ার সূচনা থেকে সম্মুখ সমর অবধি

১. মুসলিমদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কুরায়েশের একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলাকে থামানো; কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার অপরিহার্য সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাফেলাটি রক্ষা পায়, এবং মু’মিনদের মুখোমুখি হতে হয় এক সুসজ্জিত বাহিনীর। এই দ্ব্যর্থক পরিস্থিতি তাদের জন্য বিজয় ও গনিমতের দ্বৈত অর্জনের দিক উন্মোচন করে। এ ঘটনার নির্যাস থেকে দুটি মৌলিক শিক্ষা উদ্ভাসিত হয়:

ক. কাফির বাহিনীর ধনসম্পদ মুসলিমদের জন্য হারাম নয়; বরং মুসলিমদের অধিকার বলে বিবেচিত হয় এবং তাদের মালিকানায় পরিণত হয়। গাযওয়ায়ে বদরের তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ছিল কুরায়েশের ঐ কাফেলা, যা মক্কামুখী যাত্রায় ছিল। সেই সময় কুরায়েশ ছিল ঘোরতর যুদ্ধাবস্থায়, এবং তারা মুহাজিরদের ধন-সম্পদ, বাগান ও ভূসম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুহাজিরদের জন্য এই কাফেলাকে কবজা করা ছিল তাদের ন্যায্য অধিকার।

এই সিদ্ধান্ত কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহের প্রকৃত প্রতিফলন:
“وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا”
“আর পাপের প্রতিফল সে রকমই একটি পাপ।” (সূরা আশ-শূরা: ৪০)

“فَمَنِ اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ”
“আর কেউ যদি তোমাদের উপর যুলুম করে, তবে তোমরাও তার উপর তদ্রূপ যুলুম করো।” (সূরা আল-বাকারা: ১৯৪)

অতএব, কেউ যদি অজ্ঞতা কিংবা গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে মুসলিমদের এই পদক্ষেপকে দোষারোপ করে, তবে সে নিঃসন্দেহে সত্য থেকে দূরে অবস্থান করছে।

খ. বিজয়ের নির্ণায়ক কেবল সংখ্যা নয়; বরং তা নির্ধারিত হয় মান ও মহত্ত্বের ভিত্তিতে। মক্কার বাহিনী ছিল বিপুল শক্তিসম্পন্ন— তাদের ছিল অগণন ঘোড়া, অস্ত্র, সৈন্য, এবং দৈনন্দিন উট জবেহর ব্যুৎপত্তি। অপরদিকে, মদিনার বাহিনী ছিল সংখ্যায় নগণ্য, খাদ্যদ্রব্যে অনাহুত, অথচ তাদের হৃদয়ে ছিল শাহাদতের অপরিমেয় আকাঙ্ক্ষা ও ঈমানি এক প্রশান্তি। সেই আত্মিক শক্তিই ছিল তাদের প্রকৃত বিজয়ের উৎস, শহীদ হওয়া হোক বা বিজয়লাভ— উভয়ই ছিল তাদের জন্য সফলতার সমার্থক।

২. এ গাযওয়াহ মুসলিম উম্মাহকে এই অনবদ্য শিক্ষা দেয় যে, যেকোনো যুদ্ধ পরিচালনায় সেনাপতির উচিত নিজের গোয়েন্দা কার্যক্রমকে সুসংগঠিত ও সজাগ রাখা, যাতে শত্রুর গতিবিধি ও কৌশলসমূহ সম্পর্কে সচেতনতা অর্জিত হয়, এবং প্রস্তুতি গ্রহণে কোনো অপূর্ণতা না ঘটে।

৩. এই গাযওয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কৌশলী পদক্ষেপ পরামর্শের অপরিসীম গুরুত্বের প্রতিচ্ছবি। তিনি কেবল নবীই ছিলেন না; তাঁর ইজতিহাদ ছিল ত্রুটিমুক্ত, আর ভুল হলে আল্লাহ্‌ তায়ালা নিজে তা সংশোধন করতেন। তবুও তিনি তাঁর সাহাবাগণের মতামত গ্রহণ করতেন, পরামর্শ করতেন, এমনকি সামরিক কৌশল নির্ধারণেও। তাঁর এই অনুপম দৃষ্টান্ত শুধু বদরযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তাঁর সারাবেলা ছিল শূরা ও পরামর্শে পরিপূর্ণ।

অতএব বলা যায়, যেসব বিষয়ে শরিয়তের সরাসরি নির্দেশ (নস্‌) নেই, বরং তা কৌশলগত, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অন্তর্ভুক্ত, সেসব ক্ষেত্রে সহচর ও শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তিবর্গের মতামত অবলম্বন করা উচিত। কিন্তু যেখানে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নস বিদ্যমান, সেখানে মতামতের কোনো স্থান নেই; বরং বাধ্যতামূলকভাবে ঐ নির্দেশ অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক।

৪. শত্রুকে প্রতিটি অঙ্গনে পরাভূত করতে হবে, হোক তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রচারমূলক কিংবা সামরিক অঙ্গনে— যাতে তারা তাদের পথভ্রষ্ট অবস্থান থেকে ফিরে আসে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরায়েশের বাণিজ্য কাফেলাকে টার্গেট করেন, যা একদিকে ছিল তাদের ইসলাম-বিদ্বেষী কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া, অপরদিকে এক সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক যুদ্ধ। কেননা এই কাফেলায় কুরায়েশদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ গমন করছিল, যার বিনাশ তাদের জন্য এক চরম আর্থিক আঘাত হতো— এটিই ছিল কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের অন্যতম লক্ষ্য।

সুতরাং, কাফিরদের ইসলাম অস্বীকারের পর, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি ময়দানে প্রতিরোধ ও প্রভাব বিস্তার করা অপরিহার্য, যাতে যুদ্ধে সুনিপুণ কৌশলের মাধ্যমে সফলতা অর্জিত হয় এবং শত্রু সর্বস্তরে পর্যুদস্ত হয়।

Exit mobile version