দ্বিতীয়: গাযওয়াতু বুওয়াত
গাযওয়াতের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় গাযওয়া হলো বুওয়াত, যা হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে রবিউল আউয়াল বা রবিউস সানি মাসে সংঘটিত হয়। ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সংবাদ প্রদান করা হয় যে, উমাইয়া ইবনু খালাফের নেতৃত্বে কুরাইশের একটি বাণিজ্য কাফেলা মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। নবী করিম ﷺ দুই শত অশ্বারোহী সাহাবির একটি সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে কাফেলাটিকে প্রতিহত করার সংকল্প করেন এবং বুওয়াত অঞ্চলের অভিমুখে গমন করেন।
এই গাযওয়াহয় ইসলামী পতাকা ছিল শুভ্র, আর তার বাহক নিযুক্ত হয়েছিলেন হযরত সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু। তবে কাফেলাটি আগেই পথ পরিক্রমণ করায় কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি, এবং মুসলিম বাহিনী কোনো সংঘর্ষ ব্যতীতই মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে। এ সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ মদিনার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করেন হযরত সায়েব ইবনু মাযউন রাদিয়াল্লাহু আনহুর ওপর, যিনি ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের সম্মুখসারির সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
বুওয়াত এক পর্বতের নাম, যা মক্কা হতে শামগামী দীর্ঘ পথের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং মদিনা মুনাওয়ারার প্রায় ৪৮ মাইল দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত।
—
তৃতীয়: গাযওয়াতুল ‘উশায়রা
সিরাত বিশেষজ্ঞদের মতে, গাযওয়াতুল ‘উশায়রা ইসলামের সামরিক অভিযানের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় গাযওয়া। এটি ছিল নবী করিম ﷺ-এর নেতৃত্বে পরিচালিত তৃতীয় সেনা অভিযান, যাতে দুই শত মুহাজির সাহাবি অংশগ্রহণ করেন। এই অভিযান সংঘটিত হয় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে, যখন কুরাইশের একটি বাণিজ্য কাফেলা শামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, আর মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে যাত্রা করে ‘উশায়রা অঞ্চলে গমন করে।
যাত্রাপথে তাঁরা ইবনু আজহারের মরুপ্রান্তরে এক বিশাল বৃক্ষতলে অবকাশ গ্রহণ করেন, সেখানে আহার পর্ব সম্পন্ন করেন এবং সালাত আদায় করেন। অতঃপর তাঁরা ইয়ালিল নামক স্থানে বিরতি গ্রহণ করেন এবং পরিশেষে ‘উশায়রায় উপনীত হন।
মদিনায় অনুপস্থিতির সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করেন হযরত আবু সালামা ইবনু আবদুল আসাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ওপর। তবে কাফেলাটি আগেই নির্ধারিত পথ পরিক্রমণ করায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। তবে এই অভিযানে মুসলিম বাহিনী বনু মুদলিজ গোত্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে এবং অতঃপর মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে।
উল্লেখ্য, এটিই সেই কাফেলা, যা পরবর্তী সময়ে শাম থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু হয় এবং ফলস্বরূপ ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ ‘বদর’ মহাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
—
একটি সংশয় ও তার নিরসন
এই তিন গাযওয়াহর উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশদের কাফেলাগুলোর গতিপথ প্রতিহত করা, যা কখনো মক্কা থেকে শামের দিকে অগ্রসর হতো, আবার কখনো শাম থেকে মক্কার দিকে প্রত্যাবর্তন করত। ইসলামবিরোধীরা এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করে বলেন, কেন রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবিগণ ব্যবসায়িক কাফেলাগুলোর গতিরোধ করলেন? তারা এটিকে ইসলামি নীতির পরিপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়।
এই আপত্তির খণ্ডন এই যে— রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবিগণ কুরাইশদের সীমাহীন অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়ে মক্কা থেকে বলপ্রয়োগে বিতাড়িত হয়েছিলেন। তাঁদের সমগ্র সম্পদ, আবাসভূমি ও খেত-খামার অন্যায়ভাবে কুরাইশরা আত্মসাৎ করেছিল। সুতরাং, এই গাযওয়াহগুলো মূলত তাঁদের আত্মসাৎকৃত সম্পদের পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা ছিল অথবা ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রয়াস ছিল। এটি কোনো অন্যায় আক্রমণ বা কারও সম্পদের প্রতি অবৈধ আগ্রাসন ছিল না।
এই কারণেই বদরের যুদ্ধ পর্যন্ত সংঘটিত সমস্ত গাযওয়াহয় কেবল মুহাজির সাহাবিরাই অংশ নিয়েছিলেন, আনসারদের কোনো ভূমিকা ছিল না। কারণ, এই যুদ্ধ ছিল কেবল কুরাইশ ও মুহাজির মুসলিমদের মধ্যকার একটি ন্যায়সংগত সংগ্রাম, যেখানে মুহাজিরগণ তাঁদের আত্মমর্যাদা, ধর্মবিশ্বাস ও আত্মসাৎকৃত সম্পদের পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছিলেন।