২ অক্টোবর : আমাদের ভুলে যাওয়া দিন!

✍🏻 আযীয জলিল

ইতিহাসে এমন কিছু দিন আছে, যা কেবল মুসলিমদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যও গৌরবের প্রতীক। সেই উজ্জ্বল দিনগুলোর একটি হলো ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর, যেদিন সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহ নিপীড়িত মুসলিমদের ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে শিফা দিয়েছিলেন, বায়তুল মুকাদ্দাসকে ক্রুসেডারদের নিষ্ঠুর দখল থেকে মুক্ত করেছিলেন, এবং ইসলামের পতাকাকে আকসার আকাশে পুনরায় উড্ডীর্ণ করেছিলেন।

সালাহুদ্দীন আইয়ুবী ছিলেন এক মহামানব মুজাহিদ, ন্যায়নিষ্ঠ শাসক ও দূরদর্শী নেতা, যিনি ছিলেন জ্ঞান, ন্যায়, তাকওয়া ও জিহাদের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁর সাহস, স্থিরতা ও আল্লাহর সাহায্যের উপর অটল বিশ্বাসের মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে বুঝিয়েছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাস কোনো ব্যবসায়ীর দর-কষাকষির বিষয় নয়, বরং তা দাবি করে মুমিন পুরুষদের রক্তসিক্ত কপালের নিদর্শন।

বায়তুল মুকাদ্দাস ৮৮ বছর ক্রুসেডারদের দখলে ছিল। এই শহর তিনটি আসমানী ধর্মের জন্যই পবিত্র, কিন্তু মুসলিমদের জন্য এটি কেবল পবিত্র নগর নয়; এটি কিবলা-এ-আউয়াল, ইসরা মিরাজের স্থান এবং আধ্যাত্মিক বন্ধনের প্রতীক। ক্রুসেডাররা সেখানে এমন নির্মমতা চালিয়েছিল যে, মসজিদুল আকসাকে তারা ঘোড়াশালা বানিয়েছিল এবং হাজারো মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

কিন্তু সালাহুদ্দীন ভয় পাননি। তিনি হিত্তিনের ঐতিহাসিক যুদ্ধে ক্রুসেডারদের এমন পরাজয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন যে তাদের অহংকার মাটিতে মিশে যায়। এই যুদ্ধ কেবল সামরিক বিজয়ই ছিল না, বরং ছিল মুসলিমদের আকীদা, ঐক্য ও ঈমানেরও এক দীপ্ত দলিল।

যখন সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহ দীর্ঘ সংগ্রাম, অসংখ্য ত্যাগ ও অতুলনীয় বীরত্বের পর বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর চিত্তে ছিল না অহংকারের গর্ব, বরং বিনয় ও কৃতজ্ঞতার গভীর অনুভূতি। তিনি মসজিদুল আকসার মিহরাব পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, হাঁটু মাটিতে ঠেকিয়ে কেঁদেছিলেন, আর কৃতজ্ঞ হৃদয়ে সেজদায় ঝুঁকে আল্লাহর প্রশংসা করেছিলেন। তিনি জানতেন এই বিজয় কেবল তরবারির নয়, বরং এটি আল্লাহর সাহায্যের প্রতিফলন। সেই মসজিদুল আকসা, যা প্রায় এক শতাব্দী ধরে শত্রুর দখলে ছিল, আজ আবার ঈমানদারদের বুকে ফিরে এসেছে।

সালাহুদ্দীন এই বিজয় অর্জন ক্ষমতা বা পার্থিব লালসার জন্য করেননি; বরং উম্মাহর মর্যাদা, করেছিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নির্যাতিত মুসলিমদের মুক্তির জন্য। এই আকসা সেই স্থান, যার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিশেষ আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল; আর আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহ তাঁর হৃদয়ের রক্ত, দু’আ, পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে পুনরায় সেটিকে স্বাধীন করেছিলেন।

কিন্তু আজ! হে আজকের তরুণ! হে উম্মাহর সন্তান! নিজেকে প্রশ্ন করো! আজ আকসা আবারও বন্দী, আর তুমি কী করছো? আজ হাজারো ফিলিস্তিনি শিশু শহীদ হচ্ছে, আর তুমি কোথায়? আজ সত্যের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, অথচ তুমি নীরব কেন? সালাহুদ্দীন কেবল তরবারি দিয়ে নয়, বরং ঈমান, তাকওয়া, জ্ঞান ও সাহস দিয়ে উম্মাহর সম্মান ফিরিয়ে এনেছিলেন। তিনি ছিলেন ঐক্যের আহ্বান, তিনি ছিলেন নির্যাতিতদের সহায়ক, তিনি ছিলেন আল্লাহর পথে আত্মত্যাগের জীবন্ত দৃষ্টান্ত।

আজও আকসার মিহরাব, মিনার ও প্রাচীর থেকে করুণ আর্তনাদ ভেসে আসে—ইয়াতিমদের চিৎকার, নিপীড়িতদের কান্না। যে আকসা সালাহুদ্দীন রক্ত দিয়ে মুক্ত করেছিলেন, সেটি আজ আবারও আমাদের উদাসীনতা, বিভাজন আর উম্মাহর অধঃপতনের কারণে দখলকৃত। উম্মাহর ঘুমন্ত নিস্তব্ধতা আজ আকসার মাটিতে অন্যায়ের ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে। হে মুসলিম! অনেক ঘুমিয়েছো! এখন জেগে ওঠো! তুমি সেই মহান বীর সালাহুদ্দীন আইউবীর উত্তরসূরি। আজ তাঁর তাকওয়া, গৌরব, সাহস ও দায়িত্ববোধের আবার প্রয়োজন। আকসা তোমার অপেক্ষায় আছে।

আমাদের বুঝতে হবে—উম্মাহর মর্যাদা কেবল সভা, সমাবেশ বা স্লোগানে লাভ হয় না; ঈমান, ত্যাগ, কর্ম ও বীরত্বই এর চাবিকাঠি। যদি আজ আমরা নীরব থাকি, তবে আগামীকাল ইতিহাস আমাদের অবহেলায় কলঙ্কিত হবে। আল্লাহ আমাদের সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর মতো গৌরব, ঈমান ও সাহস দান করুন, যাতে একদিন আবার আকসার আকাশে স্বাধীন হৃদয়ের আযান প্রতিধ্বনিত হয়।
والله غالب على أمره — নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কাজে পরাক্রমশালী।

Exit mobile version