সম্প্রতি জাতিসংঘের বিশ্লেষণ ও নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণ কমিট তাদের ৩৫তম প্রতিবেদন নিরাপত্তা পরিষদের নিকট জমা দিয়েছে। প্রতি অর্ধবছরে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন বিশ্বপরিসরে আইএসআইএস, আল কায়েদা এবং অন্যান্য তথাকথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে। সর্বশেষ সংস্করণে ২০২৪ সালের মধ্যভাগ থেকে ডিসেম্বরের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলি বিশ্লেষিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিগত গ্রীষ্মে আইএস-খোরাসানের তিনজন প্রধান অপারেটিভকে আটক করেছে, যার ফলে দেশটিতে সংগঠনটির সুদৃঢ় ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার অভিলাষ বিপর্যস্ত হয়েছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা হলেন আদিল পানশেরি, কাকা ইউনুস উজবেকিস্তানি এবং আবু মুনজির তাজিকিস্তানি।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সচরাচর এমন সাফল্য জনসমক্ষে প্রচার করায় দ্বিধাবোধ করে না। তথাপি এই তথ্য জাতীয় প্রচারমাধ্যমের পরিবর্তে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণকারী দলের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া একাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
ইসলামী ইমারাত আফগানিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মুখে আইএস-খোরাসানের নেতৃত্ব পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় তাদের কার্যক্রম পুনর্গঠনের প্রয়াস নেয়। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাসমূহ এবং এমনকি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী-সমর্থিত প্রচারমাধ্যম পর্যন্ত এই বাস্তবতাকে নিশ্চিত করেছে।
যে পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বর্তমানে পানশেরি, ইউনুস ও আবু মুনজিরের গ্রেফতারের দাবিদার, তারাই পরোক্ষভাবে আল মিরসাদসহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের সেই প্রতিবেদনগুলিকে সত্যতা দিচ্ছে যে, আইএস-খোরাসান পাকিস্তানেই তাদের কৌশলগত কেন্দ্র স্থাপন করেছে এবং সেখান থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, আদিল পানশেরি ও তার সহযোগীদের ৩ জানুয়ারি ২০২৪-এ ইরানের কেরমান শহরে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৪০০ ব্যক্তি হতাহত হন। পাকিস্তানে তাদের গ্রেফতার এই সত্যকে আরও সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, কেরমানের ধ্বংসযজ্ঞের পরিকল্পনা মূলত বেলুচিস্তানের মাটিতেই রচিত হয়েছিল। আর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা সম্ভবত কেবল নিজেদের আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তাদের বন্দী করেছে।
(গোপন নিরাপত্তা সূত্রমতে, আদিল পানশেরি ২ নভেম্বর ২০২০-এ কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত নৃশংস হামলার মূল সংগঠক ছিল, আর আবু মুনজির তাজিকিস্তানি মস্কোর ক্রোকাস সিটি হল হামলার পরিকল্পনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।)
উল্লেখযোগ্যভাবে পাকিস্তান সম্ভবত আদিল পানশেরিকে কূটনৈতিক দর-কষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, বিশেষত ইরানের নিকট কিছু বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীর বিনিময়ে তাকে হস্তান্তর করার জন্য। এটি পাকিস্তানের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ, যার মাধ্যমে দেশটি আঞ্চলিক রাজনীতির ভারসাম্য নিজের পক্ষে টেনে আনতে সচেষ্ট।
কেরমান হামলার মেধাবী পরিকল্পনাকারী ছিল একজন তাজিক নাগরিক, যে “তারিক” এবং “আবদুল্লাহ” ছদ্মনামে পরিচিত। সে বর্তমানে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে নির্বিঘ্নে বসবাস করছ। তবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণকারী দলকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসে দাবি করেছে যে, তিনি আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই অপারেশন পরিচালনা করছেন।
কেরমান হামলার পাশাপাশি, তারিক ২০২৩ সালের মার্চ মাসে কান্দাহার হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল। সে হামলাকারী আসাদবেক মাদিয়ারোভকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের প্রশিক্ষণ শিবিরে সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত করেছিলেন এবং পরে তাকে কান্দাহারে পাঠায়।
পাকিস্তান দৃশ্যত আন্তর্জাতিক মনোযোগকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, যেন বিশ্ববাসী বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় আইএসআইএসের সুপ্রতিষ্ঠিত ঘাঁটিগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত না হয়। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে, ততই পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা উন্মোচিত হচ্ছে এবং তার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে।
যদি বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় অবস্থিত আইএসআইএসের এই শক্ত ঘাঁটিগুলো নির্মূল করা না হয়, তবে কেরমান, কান্দাহার, কাবুল এবং অন্যান্য শহরের মতো আরও অনেক ধ্বংসাত্মক হামলার সাক্ষী হতে হবে বিশ্বকে।