যে পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা একদিন “ইসলামের দুর্গ”—নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, আজ তা পুরো অঞ্চলের অশান্তি ও অস্থিতিশীলতার প্রধান কারণগুলোর একটি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। জনগণের কল্যাণরক্ষার দায়িত্ব যার ছিল, সেই রাষ্ট্রযন্ত্র আজ দুর্নীতিগ্রস্ত সেনানায়ক ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের হাতে পরিণত হয়েছে কেবল ক্ষমতা ও সম্পদ রক্ষার এক নিষ্ঠুর অস্ত্রে।
যে সেনাবাহিনী একসময়ে দেশের সীমান্তরক্ষার প্রহরী হিসেবে পরিচিত ছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে এক দমন-যন্ত্রে, যারা নির্দ্বিধায় নিরপরাধ বেলুচ, পশতুন ও কাশ্মীরিদের রক্ত ঝরাচ্ছে। বেলুচিস্তানে এই বাহিনীর অপরাধ এতই ভয়াবহ যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে “নীরব গণহত্যা” বলে অভিহিত করেছে। প্রায় প্রতিদিন মরুভূমি থেকে উদ্ধার হয় তরুণ বেলুচদের নিথর দেহ, আর প্রতি সপ্তাহেই বহু মানুষ হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়।
কাশ্মীরেও এই সেনাবাহিনী ধর্মীয় চরমপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে অঞ্চলটিকে অস্থিরতার অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছে এবং নিরপরাধ কাশ্মীরি জনগণকে অন্তহীন দুর্ভোগে নিমজ্জিত করেছে। এই শাসনযন্ত্র সন্ত্রাসের আগুনে ঘি ঢেলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
পাকিস্তানের ভেতরের পরিস্থিতি তার পররাষ্ট্রনীতির চেয়েও করুণ। দুর্নীতি, দ্রুত বর্ধমান বেকারত্ব, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘনঘন ঘাটতি—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছে। অথচ সেনানায়ক ও রাজনীতিকেরা রাজপ্রাসাদে বিলাসে নিমগ্ন, আর সাধারণ মানুষ এক টুকরো রুটির জন্য হাহাকার করছে।
জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অস্থিরতা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও খাইবার প্রদেশে জনঅভ্যুত্থানের ঢেউ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। মানুষ এখন স্পষ্টভাবে বুঝে ফেলেছে যে, তাদের সব দুর্দশার মূল উৎস ইসলামাবাদের লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকগোষ্ঠী। আজ পাকিস্তানের প্রতিটি প্রান্তে ধ্বনিত হচ্ছে—“দখলদার সরকার, হত্যাকারী সেনাবাহিনী”—এই প্রতিবাদের স্লোগান।
জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে এই শাসকগোষ্ঠী সবসময় বাইরের শত্রুর ঘাড়ে সব চাপানোর অপচেষ্টা করে, কিন্তু এখন সেই পুরনো চাল আর ফল দিচ্ছে না। পাকিস্তানের জনগণ এখন স্পষ্ট জানে, আসল শত্রু তাদের সীমানার বাইরে নয় ভেতরেই রয়েছে; এক পচা ব্যবস্থা, যা জাতির সম্পদ লুটে নেয় এবং তরুণ প্রজন্মকে ভাড়াটে যুদ্ধে বলি দেয়।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফগানিস্তান। পাকিস্তানের এই নোংরা নীতির শিকার হয়ে দেশটি বছরের পর বছর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বন্ধুত্বের মুখোশ পরে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বহু বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে আসছে। দাঈশের মতো রক্তপিপাসু সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা এখন এই শাসকব্যবস্থার সরকারি নীতিতে পরিণত হয়েছে। জনগণের করের টাকায় গড়ে তোলা বাজেট ব্যয় করা হচ্ছে ওইসব সংগঠনকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিতে। পাকিস্তানের গোপন সংস্থাগুলো ধর্মীয় উগ্রবাদীদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে রূপ নিয়েছে, আর সেনানায়করা গর্বের সঙ্গে এই কর্মকাণ্ডকে “গোপন ধর্মযুদ্ধ” বলে প্রচার করে।
বিশ্বসমাজকে বুঝতে হবে, আজকের পাকিস্তান কোনো আইননিষ্ঠ রাষ্ট্র নয়; এটি এক সামরিক-রাজনৈতিক চক্র, যারা সন্ত্রাসবাদকে রাষ্ট্রনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যতদিন এই শাসনচক্র তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে, ততদিন দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা কেবল কল্পনা হয়েই থাকবে।
এখনই সময় এসেছে, বিশ্বসমাজকে এই অপরাধচক্রের অবসান ঘটাতে হবে। পাকিস্তানের জনগণকেও জেগে উঠতে হবে, এই দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকগোষ্ঠীকে ইতিহাসের আবর্জনায় নিক্ষেপ করতে হবে। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ওপর, একটি ন্যায়ভিত্তিক ও জনগণমুখী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, যা প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে। কেবল সেই দিনই পাকিস্তান অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।




















