আফগানিস্তানের মৌলিক উন্নয়ন; যে অগ্রগতি সীমান্তের ওপারে অস্বস্তির ঢেউ তোলে!

জামিল আকবার

আফগানিস্তানকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হলে এই ভূমির ঐতিহাসিক সত্যকে সামনে রাখতে হয়। ইতিহাসের অমোঘ সত্য হলো, আফগানিস্তান সেই দেশ—
• যে দেশ বরাবরই বিশ্বের মহাশক্তিধর ও দমনপীড়নকারী সাম্রাজ্যগুলোকে পরাজিত করেছে (ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা),
• যে অতীতে নিজেও এক পরিপক্ব ও সুসভ্য সাম্রাজ্যের মর্যাদা ধারণ করেছিল,
• এবং যদিও অধিকাংশ সময় যুদ্ধের প্রান্তর হয়েছে, তবুও নিজের পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য সর্বদা অটুট রেখেছে।

এই বিষয়গুলো আফগানিস্তানের সোনালি অতীতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাস্বরূপ, এবং এটিও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে “এই জাতি দুর্জেয়, দুর্বলতা স্বীকার করে না; আর যদি তাকে স্বাধীনভাবে এগোতে দেওয়া হয়, তবে সে এক সভ্য ও শোভন রূপান্তর বয়ে আনে।”

এভাবেই আফগানিস্তানের গভীর বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হয় তখনই, যখন এই মুসলিম জাতির শক্তির উৎসগুলো পর্যালোচনা করা হয়। ফলে বলা যায়, বহু দিক থেকে আফগান জাতি বিশ্বের অন্যতম দৃঢ় ও শক্তিমান জাতিগুলোর অন্তর্ভুক্ত।

১. যুদ্ধজয়ী প্রতিরোধ
বিশ্বের ইতিহাসে এমন কোনো জাতি নেই, যারা এক শতাব্দীর ভেতর পরপর তিনটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেছে এবং শতাব্দীব্যাপী সংকটের মাঝেও নিজের পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেছে।

২. আফগানি পরিচয়
দীন, মর্যাদাবোধ, ঐতিহ্য, ভাষা এবং গ্রামীণ সামাজিক সংহতি—এগুলোই আফগান মুসলিম জাতির পরিচয়ের স্তম্ভ। প্রলয়ংকারী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যেও একমাত্র এই জাতিই নিজের মূল রঙ বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করেনি।

৩. তরুণ জনসংখ্যা ও শক্তিমান মানবসম্পদ
আফগানিস্তানের ৭৫% এর অধিক জনগণ ত্রিশ বছরের নিচে। এই বলিষ্ঠ মানবসম্পদ বিশ্বমানের তুলনায় এক সাহসী, কর্মঠ ও পরিশ্রমী প্রজন্মের পরিচায়ক।

৪. কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান
বিশ্ব মানচিত্রে আফগানিস্তান এমন এক ভূরাজনৈতিক কেন্দ্রে অবস্থিত, যেখানে মধ্য এশিয়ার শক্তি, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি, আরব বিশ্বের প্রভাব, চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত বাস্তবতা—সবকিছুর সেতুবন্ধন ঘটে। এই অবস্থানই আফগানিস্তানকে স্বভাবত এক ভূ-রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

৫. দুর্বল সরকারব্যবস্থা
আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ইতিহাস জুড়েই দুর্বল ছিল। বর্ণভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, স্থানীয় ক্ষমতাদ্বন্দ্ব এবং রাষ্ট্রীয় আইন অস্বীকার—এসবই কখনো একটি স্থিতিশীল কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে উঠতে দেয়নি।

অর্থনীতি অনুপস্থিত, শিল্পের বিকাশহীনতা, উৎপাদনশীল খাতের অভাব, দুর্বল রপ্তানি ও কৃষির বৈরী অবস্থা মিলিয়ে দেশকে স্বনির্ভর অর্থনীতির বদলে পরিণত করেছে ত্রাণনির্ভর ও বহির্ভূত তহবিলের ওপর নির্ভরশীল এক রাষ্ট্রে।

প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ছিল এমন দ্বিতীয় কারণ, যা গত একশো বছরে ধারাবাহিক সংস্কারকে সম্ভব হতে দেয়নি। দুর্নীতি প্রোথিত হয়েছে গভীরে, আর দক্ষ পেশাজীবীরা হয় নিঃশেষ হয়েছেন, নয়তো ছড়িয়ে পড়েছেন দেশে-বিদেশে।

জাতীয় চেতনার দুর্বলতা দেশটিকে রাজনৈতিক বিভাজন, জাতিগত বিরোধ আর আঞ্চলিক প্রভাবের লড়াইয়ে নিমজ্জিত করে দীর্ঘ আন্তর্জাতিক খেলায় বলির পাঠা বানিয়েছে।

৬. সম্ভাবনার চিত্ররূপ
আফগানিস্তানে বিদ্যমান আছে লিথিয়াম, সোনা, তামা ও বিরল খনিজসমূহ—যার আনুমানিক মূল্য এক থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত।

৭. আঞ্চলিক ট্রানজিট
সি-প্যাক, কাসা-১০০০, টাপি, বাণিজ্যিক রুট—এই প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হলে আফগানিস্তান হতো আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।

৮. কৃষি ও জ্বালানি
আফগানিস্তানের রয়েছে ব্যাপক জলসম্পদ। জাফরান, বাদাম, চিলগোজা ও মধুর বিশ্ববাজারে আফগানি পণ্যের সুরক্ষা ও চাহিদা সুবিদিত। তদুপরি সৌর ও বায়ুশক্তির বিপুল সম্ভাবনাও নিহিত।

৯. অর্থনৈতিক প্রয়োজন
অর্থনীতি কখনো পুরোপুরি পুনরুদ্ধার না হওয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও কখনো স্থায়ী হয়নি।

১০. বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ
বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বরাবরই আফগান মুসলিম জাতির পরিচয়কে লক্ষ্যবস্তু করেছে। সেক্যুলার প্রকল্প, মতাদর্শগত হামলা, বহিরাগত মিডিয়া প্রচারণা ও মানসিক দখল—এসব ছিল এক নতুন ধ্বংসযজ্ঞ।

১১. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট
আফগানিস্তানে বরাবরই তৈরি করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব—যা সবচেয়ে বিপজ্জনক সংঘর্ষ, কারণ এগুলো বহিরাগত প্রভাবের দরজা খুলে দেয়।

১২. সার-সংক্ষেপ
পূর্বে আফগানিস্তানের অবস্থা ছিল—জাতি শক্তিশালী, কিন্তু সরকার দুর্বল।
যদি আজকের মতো জাতির শক্তি ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা একত্রে থাকত, তবে আফগানিস্তান বহু আগেই অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হতো। আফগানিস্তান কখনো অসহায় ছিল না, নিরাশও নয়—কিন্তু বিশৃঙ্খল অবশ্যই ছিল।

আজকের আফগানিস্তান
• সংগঠিত,
• শক্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণীত ও প্রয়োগাধীন,
• অর্থনৈতিক, গোয়েন্দা, প্রতিরক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নীতি—সবই স্বতন্ত্রভাবে প্রণীত,
• প্রতিটি পদক্ষেপ ইতিহাসনির্ভর ও কৌশলগত বিশ্লেষণসম্মত,
• জাতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, স্থানীয় ক্ষমতাদ্বন্দ্ব ও রাষ্ট্রীয় আইন অস্বীকার—সমাপ্ত,
• অর্থনৈতিক গতিশীলতা, শিল্পগত অগ্রগতি, উৎপাদনশীল খাতের উত্থান, রপ্তানি বৃদ্ধি—জারি,
• কৃষির ক্রমোন্নতি,
• ত্রাণনির্ভরতা থেকে স্বনির্ভর অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দিকে অগ্রযাত্রা,
• প্রতিষ্ঠানগুলো শৃঙ্খলায় প্রবেশ করছে,
• প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জারি আছে,
• প্রশাসনিক দুর্নীতি বিলোপিত,
• ছড়িয়ে থাকা দক্ষ জনবল পুনর্গঠিত ও নিয়োজিত,
• রাজনৈতিক বিভাজন, জাতিগত দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক প্রভাব—এসবের যুদ্ধ থেকে মুক্তি,
• সম্ভাবনার চিত্রায়ণ,
• লিথিয়াম, সোনা, তামা ও বিরল খনিজ—পেশাদারিত্বের সঙ্গে উত্তোলন,
• আঞ্চলিক ট্রানজিট সক্রিয়,
• সি-প্যাক, কাসা-১০০০, টাপি—সমুচিত ব্যবস্থাপনায় অগ্রসর,
• আফগানিস্তান আঞ্চলিক বাণিজ্যের হৃদয় হয়ে উঠছে,
• বৃহৎ জলাধারের নিয়ন্ত্রণ,
• জাফরান, বাদাম, চিলগোজা, ডালিম, আপেল, ফলমূল ও মধুর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার,
• সৌর ও বায়ুশক্তির বিস্তৃত সম্ভাবনা,
• দেশের জন্য হুমকির (Threats) পূর্ণ মানচিত্র প্রস্তুত,
• গোয়েন্দা অবরোধ থেকে উত্তরণ,
• প্রতিবেশীদের কৌশলগত স্বার্থকে ভারসাম্যপূর্ণ নীতির ছায়ায় রাখা,
• কৌশলগত গভীরতা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভাবের সংরক্ষণ, বিরোধী নীতি এড়ানো, নিরাপত্তার ভারসাম্য ও আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণকে সংঘাত থেকে দূরে রাখা,
• গোয়েন্দা সংঘর্ষ ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ,
• অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য বৈশ্বিক উদ্যোগ,
• রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্থায়ীকরণ,
• বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ থেকে প্রতিরক্ষা,
• আফগান মুসলিম জাতির পরিচয়ের সংরক্ষণ,
• সেক্যুলার প্রকল্প, মতাদর্শগত আক্রমণ, বহিরাগত প্রচারণা ও মানসিক আধিপত্যের কঠোর মোকাবিলা,
• অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের অবসান
• এবং বহিরাগত প্রভাবের দরজার পরিপূর্ণ বন্ধ।

এগুলোই সেই কার্যক্রম—যা বর্তমান আফগান সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তা, গভীরতা ও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে; এবং এগুলোর বাস্তবায়ন চলছে ও ইনশাআল্লাহ চলতে থাকবে।

 

Exit mobile version