বেলুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেসে হামলা; এটি কী বার্তা দিচ্ছে?

✍🏻 আবদান সাফি

বেলুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেসে সংঘটিত হামলা আরেকবার বিশ্বকে সেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে, এ ভূখণ্ড পাকিস্তানের অদূরদর্শী নীতির বলি। এই ঘটনা কেবল পাকিস্তানি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার নগ্ন প্রকাশ নয়, বরং এটি বেলুচ প্রতিরোধের এক অনিবার্য বার্তা— যা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্র ধূলিসাৎ করতে পারবে না। যারা এখনো বেলুচিস্তানের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে আত্মপ্রবঞ্চনায় ডুবে আছেন, তাদের জন্য এটি এক নির্মম শিক্ষার উপলব্ধি।

বেলুচিস্তান : বঞ্চনা, নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় অমানবিকতার এক দীর্ঘ অধ্যায়

বেলুচিস্তান সুদীর্ঘকাল যাবৎ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক অবহেলা, সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। এই অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও বিক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছে, তার পেছনে কয়েকটি অনস্বীকার্য কারণ বিদ্যমান:

১. অর্থনৈতিক শোষণের নিষ্ঠুর প্রহসন
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্পদশালী প্রদেশ, কিন্তু এর প্রাকৃতিক ভাণ্ডার থেকে সঞ্চিত সম্পদের সুফল ভোগ করে কেবল কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্যান্য প্রদেশসমূহ। পক্ষান্তরে, বেলুচ জনগণ মৌলিক জীবনপ্রবাহ থেকেও বঞ্চিত, আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ছিটেফোঁটাও তাদের ভাগ্যে জোটে না।

২. গুম-খুনের অভিশাপ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
বেলুচ জাতীয়তাবাদী কর্মী, ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিকদের নিখোঁজ করে ফেলার এক নির্মম প্রবণতা বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো পর্যন্ত এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন তাতে ক্ষান্ত হয়নি।

৩. সেনা অভিযানের অবসানহীন বিভীষিকা
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লাগাতার অভিযান, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও নির্মম বোমাবর্ষণ সাধারণ জনগণকে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করছে। রাষ্ট্র যখন জনগণের আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার ওপর আঘাত হানে, তখন প্রতিরোধই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র ভাষা।

৪. রাজনৈতিক সংলাপের অনুপস্থিতি
সরকার বরাবরই বেলুচ নেতৃত্বের সঙ্গে সংলাপের পরিবর্তে বলপ্রয়োগের নীতি অনুসরণ করেছে। এর ফলে সংকট আরও জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে। শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে দমন-পীড়নের প্রয়াস জনগণের মনে চরম ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, অথচ রাজনৈতিক সমাধানের কোনো বাস্তব প্রচেষ্টা আজও দৃশ্যমান নয়।

পাকিস্তানি নিরাপত্তা ব্যবস্থার চূড়ান্ত ব্যর্থতা

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজেদের বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সংস্থা বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, অথচ তাদের চোখের সামনেই বারংবার এই ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটে! বাস্তবতা হলো, তারা জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কূটচাল, ক্ষমতার লড়াই ও বিরোধীদের দমনে অধিকতর মনোযোগী।

পাকিস্তানের ইতিহাসে গোয়েন্দা ব্যর্থতার অনবদ্য দৃষ্টান্তের অভাব নেই—

১৯৭১ সালে, এই সংস্থাগুলোর নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল।

কারগিল যুদ্ধে কৌশলগত ব্যর্থতার দরুন পাকিস্তানকে চরম লজ্জার সম্মুখীন হতে হলো।

জিএইচকিউ, জিন্নাহ এয়ারপোর্ট ও মেহরান নৌঘাঁটিতে সংঘটিত হামলাগুলো গোয়েন্দা ব্যবস্থার অক্ষমতার স্পষ্ট নিদর্শন।

প্রতিবার যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তার দায়ভার কোনো কাল্পনিক “বহিরাগত শক্তির” ওপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি সত্যিই কোনো বিদেশি শক্তি এইসব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে, তবে তা প্রতিহত করার দায়িত্ব কার?

পাকিস্তানের নীতিগত দিশাহীনতা ও পরিবর্তনের অপরিহার্যতা

এবারও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র হামলার দায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপর চাপানোর প্রয়াস পেয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো— এটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষেরই বহিঃপ্রকাশ। ক্ষমতাসীনদের উচিত দোষারোপের রাজনীতি পরিহার করে সংকট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

জাফর এক্সপ্রেসে হামলা এক সুস্পষ্ট বার্তা বহন করে— যদি পাকিস্তান বেলুচ জনগণের ন্যায্য দাবিগুলোকে স্বীকৃতি না দেয়, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। রাষ্ট্রের উচিত তার নীতিতে অবিলম্বে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন সাধন করা।

বেলুচিস্তানের সংকটের সম্ভাব্য সমাধান

যদি পাকিস্তানি সরকার সত্যিই বেলুচিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা কামনা করে, তবে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক—

১. বেলুচিস্তানে অবিলম্বে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে।
২. বিচারবহির্ভূত গুম ও হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়া অবিলম্বে রোধ করতে হবে।
৩. বেলুচ নেতৃত্বের সঙ্গে গঠনমূলক ও আন্তরিক সংলাপ শুরু করতে হবে।
৪. বেলুচ জনগণকে তাদের প্রাপ্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রদান করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুসারে মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে।

জাফর এক্সপ্রেসে সংঘটিত হামলা হয়তো কেবল সূচনা মাত্র। যদি সরকার এখনো বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। সময় এসেছে আত্মপ্রতারণার খোলস ত্যাগ করে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কারের পথে অগ্রসর হওয়ার।

পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র দীর্ঘকাল ধরে তার ব্যর্থতার দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে এসেছে। কিন্তু বেলুচিস্তানের সংকট প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের নিজস্ব ভুল নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। যদি সরকার প্রকৃত অর্থে স্থিতিশীলতা চায়, তবে সামরিক বলপ্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যথায়, ইতিহাস বারবার এই প্রশ্নই তুলবে— “এই ব্যর্থতার দায়ভার কার?”

Exit mobile version