দাঈশের উত্থান; মানবিক মূল্যবোধের পতন!

✍🏻 অজমল জালাল

দাঈশ, যারা নিজেদেরকে “ইসলামী সরকার” নামে পরিচয় দিতে চায়, প্রকৃতপক্ষে মানবতার মৌলিক নীতিমালা এবং ইসলামের খাঁটি মূল্যবোধ থেকে বহু দূরে বিচ্যুত এক বিভ্রান্ত সংগঠন এটি। তাদের কর্মযজ্ঞ না শরীয়তের প্রতিনিধিত্ব করে, না মানবতার; বরং এটি নৃশংসতা, রক্তপাত, প্রতারণা ও অত্যাচারের এক ভয়াবহ বিভীষিকা। ইসলামের পবিত্র নাম এখানে ব্যবহৃত হয়েছে কেবলমাত্র এক শ্লোগানরূপে, অথচ ইসলামের রহমত ও তার নির্মল সত্তা তাদের হাতে লাঞ্ছিত, পদদলিত ও অপমানিত হয়েছে। যেখানে তারা পদচিহ্ন রেখেছে, সেখানে প্রবাহিত হয়েছে রক্তের ধারা, ধ্বংস হয়েছে নগরী, বন্দী হয়েছে নারী ও শিশুরা, এবং মানবতার দিগন্তে লেগে গেছে লজ্জার কালো দাগ।

দাঈশের উত্থানের পটভূমি
দাঈশ ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মধ্যবর্তী এক অস্থির সময়ে, ইরাক ও সিরিয়ার রণক্ষেত্রে উদ্ভূত হয়। যুদ্ধের বিশৃঙ্খলা, শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা, সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ—এসব মিলিয়ে তাদের সুযোগ তৈরি হয় কিছু ভূখণ্ড দখল করার। ২০১৪ সালে তারা ইরাকের মসুল শহর দখল করে এবং তথাকথিত “খিলাফত” প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এটিই ছিল তাদের শক্তির উত্থানপর্ব, তবে একই সময়ে তারা মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধগুলো সংঘটিত করে। তাদের দখলে থাকা প্রতিটি শহর রূপ নেয় রক্তের স্রোতস্বিনীতে।

নিরপরাধ মানুষের গণহত্যা
দাঈশ নিরপরাধ মানুষের হত্যাকে ভয় সঞ্চার ও নিজের শক্তি প্রমাণের এক নির্মম প্রদর্শনীতে রূপান্তরিত করেছিল। তারা সাধারণ নাগরিকদের শিরোচ্ছেদ করত, পথের ধারে ঝুলিয়ে রাখত, এবং পরবর্তীতে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে সমগ্র পৃথিবীতে প্রচার করত। মসুল, রাক্কা, ফালুজা, দেইর আয-যোরসহ বহু নগরীতে তারা কেবলমাত্র মতভিন্নতার কারণে শত শত মানুষকে হত্যা করেছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে—২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দাঈশের হাতে ৩০ হাজারেরও বেশি নাগরিক নিহত এবং প্রায় ৭০ হাজার আহত হয়েছে। মানুষের ঈমান, ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ই হয়ে উঠেছিল তাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মানদণ্ড, এবং তারা এই সমস্ত বর্বরতাকে “খিলাফত” নামক ছদ্মবেশের আড়ালে বৈধতা দিত।

নারী ও কিশোরীদের দাসীতে পরিণতকরণ
দাঈশের বর্বরতার সবচেয়ে মর্মন্তুদ চিত্র ছিল নারীর প্রতি তাদের নৃশংস আচরণ। বিশেষ করে ইরাকের ইয়াজিদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী ও কিশোরীরা তাদের যৌনদাসত্বের শিকারে পরিণত হয়েছিল। বাড়িঘর ও গ্রাম থেকে নারীদের অপহরণ করে তারা বাজারে “দাসী” হিসেবে বিক্রি করত। রাক্কা নগরী তো পরিণত হয়েছিল এক কুখ্যাত “যৌনদাসীর বাজারে”।

নারীর মূল্য নির্ধারিত হতো বয়স, রং ও সৌন্দর্যের ভিত্তিতে। কেউ কেউ বহু ব্যক্তির মাঝে ভাগ হয়ে যেত, আর অল্পবয়সী কিশোরীদের (মাত্র ১২ কিংবা ১৩ বছর বয়সে) বিক্রি করা হতো। এটি কেবল মানবতার অবমাননাই নয়; বরং ধর্মের যাবতীয় নীতির সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ। মুক্ত হওয়া বহু নারী জানিয়েছেন, দাঈশের যোদ্ধারা এই জঘন্য কর্মকে “জিহাদুন নিকাহ” নামে বৈধতা দিতে চাইত, আর কেউ এর বিরোধিতা করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে “মুরতাদ” ঘোষণা করত।

শিশুদের বিকৃত মানসিক প্রশিক্ষণ
দাঈশ জানত, যুদ্ধ টিকিয়ে রাখার জন্য প্রজন্মের মন-মানসিকতা বিকৃত করা প্রয়োজন। তাই তারা শিশুদের জন্য বিশেষ “প্রশিক্ষণশিবির” প্রতিষ্ঠা করেছিল, যেখানে কমবয়সী শিশুদের হত্যা, বোমা প্রস্তুতকরণ এবং শিরোচ্ছেদ করতে শেখানো হতো। এই নিষ্পাপদের হৃদয়ে করুণা নয়, প্রতিশোধ; প্রেম নয়, ঘৃণা সঞ্চার করা হতো। বহু ভিডিওতে দেখা গেছে,দশ বছরের শিশুদের হাতে বন্দীদের গলা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা রক্তের দৃশ্যের অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবে দাঈশ চেয়েছিল এক নির্মম ও পাষাণ প্রজন্ম তৈরি করতে, যা সমগ্র অঞ্চলের জন্য এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।

ইসলামের অপব্যবহার
দাঈশ ইসলামের ব্যানারকে সবচেয়ে জঘন্যভাবে ব্যবহার করেছে। তারা কুরআনের আয়াতসমূহকে বিকৃত ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাত। ইসলামের রহমত, ক্ষমা, মানবিক মর্যাদা—এসবের তাদের মতবাদে কোনো স্থান ছিল না। তারা যে-কারো ভিন্নমতকে “কুফর” বা “রিদ্দাহ” বলে ঘোষণা করত, এমনকি সেই সব মুসলিমকেও যারা তাদের অত্যাচার ও সহিংসতার বিরোধিতা করত।

বাস্তবে, তাদের কর্মকাণ্ড ইসলামবিরোধী প্রচারণাকে আরও শক্তি জুগিয়েছে; কারণ বিশ্বের বহু মানুষ ইসলামকে দাঈশের বর্বরতার সঙ্গে একাকার করে দেখতে শুরু করেছিল।

সভ্যতার ঐতিহ্য ধ্বংস
দাঈশ শুধু মানুষকে হত্যা করেনি; সভ্যতার ইতিহাসও ধ্বংস করেছে। ইরাকে তারা “নিনওয়া”, “হাদর”, “নিমরূদ” ও বহু প্রাচীন শহরের প্রত্নস্থল ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে। সিরিয়ায় “পালমিরা” (তদমর)—যা মানব সভ্যতার এক অমূল্য ঐতিহ্য, তাও তারা উড়িয়ে দিয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ কেবল ভৌত সম্পদের ক্ষতিই নয়; বরং সভ্যতার পরিচয়-মূলকে মুছে ফেলার এক প্রচেষ্টা, যা মানব ইতিহাসে সংস্কৃতিনিধনের এক ঘৃণ্য উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও দাঈশের পরিণতি
যখন দাঈশের বর্বরতা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়, আন্তর্জাতিক মহল ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়, তখন জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বহু রাষ্ট্র যৌথভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ইরাক ও সিরিয়ার সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক জোটের সহায়তায়, ধীরে ধীরে দাঈশের শক্ত ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দেয়। ২০১৯ সালে সিরিয়ার “বাগুজ” অঞ্চল ছিল দাঈশের শেষ দুর্গ, সেটিও পতিত হয়।

চিন্তা ও মনোজগতের ক্ষতি
দাঈশ শুধু মানুষের জীবনই নয়, উম্মাহর ঐক্যকেও চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। তাদের বর্বরতার কারণে বিশ্বের বৃহৎ অংশ ইসলামকে সন্দেহ ও ভীতির চোখে দেখতে শুরু করেছে, যা সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য এক গভীর বেদনাময় বৌদ্ধিক ট্র্যাজেডি। তাদের সহিংসতা নিরপরাধ মানুষের মানসিক জগৎ বিকৃত করেছে; ধর্মের নাম শুনলেই বহু মানুষের মনে ভয় জন্মেছে; শান্তি ও রহমতের মূল্যবোধ ক্ষীয়মান হয়েছে।

উপসংহার
এই সত্য উচ্চারিত হয় যে, দাঈশ শুধু ইসলামী বিশ্বকে নয়, সমগ্র মানবতাকেই এক কালো দাগ দিয়ে গেছে। নারী দাসত্ব, শিশুপ্রশিক্ষণের নামে মানসিক বিকৃতি, গণহত্যা, ঐতিহ্য ধ্বংস এবং ধর্মের বিকৃতি—এসব অপরাধ মানবচেতনাকে চিরকাল ক্ষুব্ধ রাখবে।

আজ দাঈশের নৃশংসতার দলিলসমূহ মানব ইতিহাসের অংশ, এবং আন্তর্জাতিক আদালতগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।

এই সমগ্র ঘটনার সর্ববৃহৎ শিক্ষা হলো—উগ্রতা, যে নামেই হোক, মানবতার শত্রু। ইসলাম হলো করুণা, ন্যায় ও সাম্যের ধর্ম; এবং দাঈশ এই ধর্মের সবচেয়ে ভয়াবহ বিকৃত রূপ।

প্রত্যেক মানুষের জানা উচিত, দাঈশের নৃশংস মতবাদ ইসলামের নয়; বরং অজ্ঞতা, অত্যাচার ও ক্ষমতার পাষাণ ক্ষুধার প্রতিনিধিত্ব।

Exit mobile version