ইসলামি ইমারাতের বিরুদ্ধে দাঈশি খারিজিদের প্রোপাগাণ্ডা ও আপত্তিসমূহের শরঈ বিশ্লেষণ | পঞ্চম পর্ব

✍🏻 মৌলভী আহমাদ আলী

খারিজীদের দীনের সঠিক উপলব্ধি অর্জন করতে পারার কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ এভাবে ঘোষণা করেছেন—তারা “সুফাহা’উল আহলাম” (মূর্খ মস্তিষ্কসম্পন্ন) এবং “হাদীসূল আসনান” (অল্পবয়সী), অর্থাৎ তারা না বুদ্ধিমান, না বয়সে পরিপক্ব। স্বাভাবিক নিয়মেই যে ব্যক্তি অল্পবুদ্ধি ও বয়সে অপরিণত হয়, সে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা থেকে বঞ্চিতই থাকে।

এই কারণেই ইতিহাস জুড়ে যত ভ্রান্ত সম্প্রদায় বিদ্যমান ছিল, তাদের বিস্তারিত ইতিহাস, শ্রেণি-বিভাগ এবং বহু প্রখ্যাত আলিমের অস্তিত্ব লিপিবদ্ধ রয়েছে; কিন্তু খারিজীরা একমাত্র এমন ভ্রান্ত গোষ্ঠী, যাদের মাঝে কোনো জ্যেষ্ঠ ও বিশিষ্ট আলিমের নাম পাওয়া যায় না। তারা সর্বদা সংকট ও বিপর্যয়ের মাঝে জীবন কাটায় এবং স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে না। তাদের অনিষ্ট ব্যাপক হলেও অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব অত্যন্ত ক্ষীণ।

রাসূলুল্লাহ ﷺ যেমন বলেছেন—“کلما طلع قرن قطع” অর্থাৎ “যখনই এরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তখনই তাদের শিরশ্ছেদ করা হবে।” এই কারণেই তাদের কোনো সুসংগঠিত ইতিহাস, মতাদর্শ কিংবা বিশ্বাসব্যবস্থা লিপিবদ্ধ নেই। অতীতের কিংবা বর্তমানের সকল খারিজীদের বৈশিষ্ট্য একই, তারা অপ্রধান ও শাখাগত বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের তাকফীর করে।

যেসব বিষয়ে তারা তাকফীর করে, তা কখনও হয় কবিরা গুনাহ, আবার কখনও এমন বিষয় যা গুনাহ নয় বরং শরিয়তে বৈধ ও প্রশংসনীয়। যেমন, সাহাবাদের যুগে যখন এ গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে, তখন তারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সাথীদের, এবং মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সাথীদের তাকফীর শুরু করে। অথচ তাদের এ তাকফীরের ভিত্তি কোনো কবিরা গুনাহ ছিল না; বরং সেটি ছিল এমন একটি বৈধ ও শরিয়তসম্মত পদক্ষেপ, যাতে মুসলিমদের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। কিন্তু, যেহেতু তারা দীনের ব্যাপারে সঠিক অনুধাবন থেকে বঞ্চিত, অপরিণত বয়সী, অল্পবুদ্ধি ও আবেগপ্রবণ—তাই তারা ’’ان الحکم الا اللہ‘‘ (হুকুম কেবল আল্লাহরই) এই স্লোগান তোলে এবং নিজেদের বাদে সে যুগের সকল মুসলিমকে তাকফীর শুরু করে, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধও আরম্ভ করে।

ড. মুস্তফা হিলমি তাঁর গ্রন্থ “আল-খাওয়ারিজ” এ তাদের সম্পর্কে লিখেছেন—
“ومن العسیر الوقوف علی معتقدات الخوارج من واقع کتبهم فالغالب ان مکتبات المسلمین عاریة عن مؤلفاتهم”
“তাদের নিজস্ব গ্রন্থ থেকে তাদের আকিদা জানা কঠিন, কারণ মুসলিমদের লাইব্রেরিগুলো তাদের রচনাবলী থেকে শূন্য। এর কারণ, তারা সর্বদা সংকট ও বিপদের মধ্যে জীবনযাপন করে।”

তারা লেখালেখি ও রচনা করার সুযোগ পায় না। এ কারণেই প্রতিটি যুগের খারিজীরা তাদের চিন্তা ও ধর্মীয় বিশ্বাসে অন্য যুগের খারিজীদের থেকে কিছুটা ভিন্ন হয়; কিন্তু সকলের মধ্যে মিল থাকে একটি বিষয়ে—নগণ্য ও শাখাগত কারণে মুসলিমদের তাকফীর করা।

অন্যভাবে বললে, এমন কাজ, বিশ্বাস ও আমল যা কোনো মুসলিমকে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত করে না, তারা সেটিকেই তাকফীরের উপাদান মনে করে। যেমন হাফিয ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন—
“وكذلك الخوارج لما كانوا أهل سيف وقتال ظهرت مخالفتهم للجماعة حين كانوا يقاتلون الناس وأما اليوم فلا يعرفهم أكثر الناس وظهرت الخوارج بمفارقة أهل الجماعة واستحلال دمائهم وأموالهم”
“খারিজীরা যেহেতু ছিল তলোয়ারধারী ও যোদ্ধা, তাদের দল থেকে বিচ্ছিন্নতা প্রকাশ পেত মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে। আজ অধিকাংশ মানুষ তাদের চেনে না। তারা মুসলিম জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিমদের প্রাণ ও সম্পদকে নিজেদের জন্য হালাল ঘোষণা করে।”

অর্থাৎ, খারিজীদের চেনা যায় তাদের কার্যকলাপ দ্বারা, যারা মুসলিমদের তাকফীর করে এবং তাদের রক্ত ও সম্পদকে বৈধ মনে করে, বুঝতে হবে তারা-ই খারিজী। পৃথিবীতে কেউ নিজেকে “খারিজী” বলে না; বরং তারা নিজেদেরকে দৃঢ় সুন্নি মনে করে।

কখনও কখনও তাদের লেখনী আহলুস সুন্নাহর আকীদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণও হয়; কিন্তু তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন আল্লামা ড. আওয়াইস আল-মাযহার বলেন—
“فالخوارج یتم الحکم علیهم من استقرار الاحوال و تتبع المواقف ولن تجد رجلاً منهم یصرح لک انه خارجی بل قد یکون کتبه التی یکتبها کلها موافقة لعقیدة أهل السنة و عند التنزیل یکون الأمر مختلفاً”
“তাদের অবস্থা ও অবস্থান অনুসন্ধান না করে তাদের সম্পর্কে রায় দেওয়া যায় না যে তারা খারিজী। কারণ তাদের মধ্যে কেউ নিজেকে খারিজী বলে না। কখনও তাদের সমস্ত লেখাও আহলুস সুন্নাহর আকীদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়; কিন্তু বাস্তব প্রয়োগে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যায়।”

তিনি আরও বলেন—
“ونؤکد أن المشکلة لیست فی التاصیل، فالعمومات التی یستدل بها الخوارج قدیما و حدیثاً هی عمومات صحیحة ولکنهم ینزلونها علی غیر واقعها، فالمشکلة فی التنزیل کما جاء عن السلف فی وصف الخوارج أنهم ینزلون الآیات التی نزلت فی الکفار علی المؤمنین و لذالک فمشکلتهم فی التأیل الفاسد.”
“আমরা নিশ্চিত করে বলি, সমস্যা মূলনীতিতে নয়। অতীত ও বর্তমানের খারিজীরা যে সাধারণ নস থেকে দলীল গ্রহণ করে, তা সঠিক। কিন্তু তারা তা ভুল প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করে। যেমন সালাফগণ খারিজীদের বর্ণনায় বলেছেন—তারা কুরআনের যে আয়াত কাফেরদের সম্পর্কে নাযিল, তা মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করে। সুতরাং তাদের প্রকৃত সমস্যা হলো বিকৃত ব্যাখ্যা।”

হাফিয ইবনু হাজার রহ. বলেন—
“وکان یقال لهم القراء لشدة اجتهادهم فی التلاوة والعبادة الا أنهم کانوا یتأولون القرآن علی غیر المراد منهم و یستبدون برأهم و یتنطعون فی الزهد والخشوع و غیر ذالک.”
“অধিক তিলাওয়াত ও ইবাদতের কারণে তাদেরকে ‘ক্বুররাআ’ বলা হতো (কিছু বর্ণনায় ‘নুসসাক’—অতিশয় ইবাদতকারী)। কিন্তু তারা বিভ্রান্ত হয়েছিল এই কারণে যে, কুরআনের অর্থ ও তাফসীর তারা প্রকৃত অর্থের বিপরীতে নিজেদের খেয়ালমতো করত।”

যেমন, মুসলিমদের মাঝে সমঝোতা ও শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টাকে তারা “ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ”-এর আলোকে শিরক আখ্যা দেয় এবং এ মতের উপর অটল থাকে; এমনকি এ কারণে নিজের জীবন উৎসর্গ করে এবং এর বিরোধীদের মুরতাদ ও ওয়াজিবুল কাতল মনে করে।

আজকের দাঈশী খারিজীরাও একইরূপ—কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহর অর্থ ও ব্যাখ্যায় তারা ভুল করে। তারা অগভীর জ্ঞানের অধিকারী, তাদের মাঝে কোনো প্রাজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আলেম নেই। কুরআন ও সুন্নাহর ভুল ব্যাখ্যা করে তার উপর অনড় থাকে। যেমন হাফিয ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন—
“و لکن بدعة الخوارج کما یقولون کان قصداهلها متابعة النص والرسول لکن غلطوا فی فهم النصوص و کذبوا بما یخالف ظنهم من الحدیث ومعانی الایات.”
“খারিজীদের বিদ‘আত ছিল এই যে, তারা মূলত কুরআন ও রাসূলের নির্দেশ অনুসরণ করতে চেয়েছিল; কিন্তু নসের ফাহমে ভুল করেছিল। তারা তাদের ভুল অনুধাবনে অটল থাকত এবং যা তাদের বুঝের বিপরীত হতো, সেটিকে অস্বীকার করত।”

অতএব, কুরআনের যেকোনো আয়াত, যার অর্থ তাদের চিন্তাধারার বিপরীত, তারা সেটি প্রত্যাখ্যান করত। আজকের খারিজীরাও বাহ্যিকভাবে কুফরের বিরোধিতার স্লোগান তোলে; কিন্তু বাস্তবে তারা কুরআন ও হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে চরম বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত।

যে আলেম তাদের মতের বিরোধিতা করে, তারা তাকে “আলিমে সু” আখ্যা দেয় এবং তাকে ভ্রান্তপন্থী মনে করে। যে হাদীস বা তাফসীর তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরোধিতা করে, তারা তার দুর্বলতা প্রমাণ ও অস্বীকৃতিতে সচেষ্ট হয়—এমনকি বহু মুসলিম, ইসলামী সংগঠন ও আন্দোলনের বৈধ, গুনাহ নয় এমনকি প্রশংসনীয় কাজকেও তারা তাকফীরের কারণ বানায়।

Exit mobile version