মুসলিমদের মোকাবেলায় কাফেরদের সহায়তা ও সহযোগিতা বিষয়ে ইমাম তহাবী রহ. ইজমা‘ (সর্বসম্মত মত) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তহাবী রহ. সেই সব লোকদের ব্যাপারে ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন, যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করে কিন্তু কাফেরদের সহায়তা ও সহযোগিতা করে—যেমন, তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে। তাঁর বক্তব্য হলো, তাদের হত্যা করা যাবে না, কেননা তারা মুসলিম। যেমন ইবনু হাজার রহ. ফাতহুল বারী-এর দ্বাদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১০-এ হাতিব ইবনু আবি বালতা‘ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন—“এই ঘটনার মধ্যে তাদের প্রতি প্রত্যুত্তর নিহিত আছে, যারা মনে করে যেকোনো পাপ করার কারণে মুসলিমকে কাফির বলা যাবে; এবং তাদের প্রতিও, যারা নিশ্চিতভাবে দাবি করে যে সে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে; এবং তাদের প্রতিও, যারা সিদ্ধান্ত দেয় যে অবশ্যই সে শাস্তি ভোগ করবে। বরং এখানে এ শিক্ষাও রয়েছে যে, যে ভুল করেছে তার উচিত তা অস্বীকার না করে বরং স্বীকার করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা, যেন সে দুটি অপরাধ একত্র না করে। আবার এর মধ্যে রয়েছে, হকের আদায়ে কঠোর হওয়ার অনুমোদন, এমনকি কখনো এমন ভীতি প্রদর্শন করা যা আসলে প্রয়োগ করা হবে না, কিন্তু হক আদায়ের স্বার্থে অপরকে ভীত করতে বলা হয়। এর ভেতর আছে গুপ্তচরের গোপন উন্মোচন। মালিকি ফকিহদের একটি দল এই ঘটনা থেকে মুসলিম গুপ্তচর হত্যার প্রমাণ নিয়েছে, কেননা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ব্যাপারে নবীর অনুমতি চেয়েছিলেন, এবং নবী ﷺ কেবল এটুকুর জন্যই তাঁকে নিষেধ করেছিলেন যে, হাতিব ছিলেন বদরের সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত। আর কেউ কেউ বলেছেন, যদি বারবার এমন ঘটে তবে শাস্তি ভিন্ন হতে পারে। ইমাম মালিক থেকে প্রসিদ্ধ অভিমত হলো, এ বিষয়ে ইমাম ইজতিহাদ করবেন। তহাবী রহ. ইজমা‘ বর্ণনা করেছেন যে মুসলিম গুপ্তচরের রক্ত হালাল নয়। শাফেয়ি ফকিহগণ এবং অধিকাংশ বলেছেন—তাকে তাআযীর (শিক্ষামূলক শাস্তি) দেওয়া হবে; যদি সে সম্মানিত ব্যক্তি হয় তবে ক্ষমা করা হবে। একইভাবে আউযায়ী ও আবু হানিফা রহ. বলেছেন—তাকে ব্যথাদায়ক শাস্তি দেওয়া হবে এবং দীর্ঘ কারাবাসে রাখা হবে। এর মধ্যে আছে, সম্মানিত ব্যক্তির এককালীন ভুল ক্ষমা করার শিক্ষা।”
ইমাম রাযি রহ.
ইমাম রাযি রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ তাফসীর তাফসীরে কাবীর-এর অষ্টম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯২-এ লিখেছেন—মুসলিমের কাফেরের সঙ্গে বন্ধুত্বের তিনটি অবস্থা হতে পারে।
প্রথম অবস্থা: সে কাফেরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কেবল তার কুফরের কারণে, এবং তার কুফরে সন্তুষ্ট থাকে। অর্থাৎ, সে মনে করে কাফেরের আকীদা সঠিক এবং তার কুফরকে সমর্থন করে। এ ক্ষেত্রে কাফেরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা প্রকৃত অর্থে কুফর; কারণ এটি কুফরের স্বীকৃতি ও তাতে সন্তুষ্টি।
দ্বিতীয় অবস্থা: মুসলিম কেবল দুনিয়াবি দিক থেকে বাহ্যিক ভালো সামাজিক সম্পর্ক রাখে, তবে তাতে কুফরকে স্বীকৃতি দেওয়া বা তার ধর্মকে সঠিক বলা অন্তর্ভুক্ত নয়। ইমাম রাযি রহ. বলেন—এটা জায়েয এবং এতে কোনো দোষ নেই।
তৃতীয় অবস্থা: এটি উভয়ের মাঝামাঝি। না কুফর, না জায়েয; বরং হারাম। অর্থাৎ, আত্মীয়তা বা ভালোবাসার কারণে সে কাফেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে, অথচ বিশ্বাস করে যে কাফেরের ধর্ম মিথ্যা। ইমাম রাযি রহ. বলেন—
“এটি কুফর নয়, তবে নিষিদ্ধ; কেননা এমন সহায়তা ধীরে ধীরে তাকে কাফেরের ধর্মকে ভালো মনে করা এবং তাতে সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা ইসলামের বাইরে নিয়ে যায়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেছেন—‘আর যে এমন করবে, সে আল্লাহর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না।’”
রোমান ও ফারসিদের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের পছন্দ
একটি বিষয় স্মরণযোগ্য যে, কুফরকে সুন্দর মনে করা ও তাতে সন্তুষ্ট হওয়া কুফর তখনই হবে, যখন তা ইসলামের মোকাবেলায় হবে। কিন্তু যদি এক কুফরি ধর্মকে অন্য কুফরি ধর্মের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে তা কুফর নয়। যেমন, যখন রোমান ও ফারসিদের মধ্যে যুদ্ধ হলো, তখন মক্কার মুসলিমরা কামনা করেছিল যে রোমানরা বিজয়ী হোক; কারণ তারা আহলে কিতাব ছিল এবং আখিরাতকে স্বীকার করত। পক্ষান্তরে, মক্কার মুশরিকরা চাইত ফারসিরা জয়ী হোক; কারণ তারা ছিল মাজুসী ও মূর্তিপূজক, আসমানী ধর্ম-বইবিহীন এবং আখিরাতকে অস্বীকারকারী।
ইমাম কুরতুবি রহ. তাঁর তাফসীরে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন—“মুশরিকরা চাইত ফারসিরা জয়ী হোক, কারণ তারা তাদের মতোই মূর্তিপূজক। আর মুসলিমরা চাইত রোমানরা জয়ী হোক, কারণ তারা আহলে কিতাব।”
এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন—
﴿وَيَوْمَئِذٍ يَّفْرَحُ الْمُؤْمِنُوْنَ بِنَصْرِ اللّٰهِ﴾
“সেদিন মুমিনরা আল্লাহর সাহায্যে আনন্দিত হবে।”
এখানে মুসলিমদের রোমানদের বিজয় কামনা করা ছিল তাদের আহলে কিতাব হওয়ার কারণে, ইসলামের মোকাবেলায় নয়। তাই এ ছিল কেবল ধর্মীয় মিলের কারণে এক ধরনের সহমর্মিতা, যা ফারসিদের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল। কিছু বর্ণনায় এসেছে, এ কারণেই আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু রোমানদেরকে ফারসিদের তুলনায় “إخواننا” (আমাদের ভাই) বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু যদি কেউ ইসলামের মোকাবেলায় কোনো কুফরি মতবাদ বা ব্যবস্থা সমর্থন করে, তবে তা স্পষ্ট কুফর। যেমন, আল্লামা আলূসী রহ. রূহুল মাআনী-তে সূরা রূমের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন, মক্কার কাফেররা ফারসিদের বিজয়ে আনন্দ করত এবং রোমানদের মুসলিমদের ভাই আখ্যায়িত করে উপহাস করত। তখন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘোষণা করেছিলেন যে রোমানরাই ফারসিদের ওপর বিজয়ী হবে, যেমন নবী ﷺ সুসংবাদ দিয়েছেন। ইবনু কাসীর রহ, ইমাম তিরমিজি রহ. প্রমুখ মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণও একই অর্থের বহু বর্ণনা এনেছেন।
এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়, যদি কোনো মুসলিম এক কুফরি ব্যবস্থার বিপরীতে অন্য কোনো কুফরি ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, তবে তা কুফর নয়। কিন্তু যদি ইসলামকে প্রতিদ্বন্দ্বী করে কোনো কুফরি ব্যবস্থার প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য দেখায়, তবে তা স্পষ্ট কুফর। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দুস্তানে আমাদের আকাবির যেমন শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. প্রমুখ আলেমগণ সেক্যুলার ব্যবস্থাকে কোনো এক পর্যায়ে সমর্থন করেছিলেন—এটা ইসলামবিরোধী বলে নয়, বরং হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে থাকার কারণে। কারণ সেক্যুলার ব্যবস্থায় অন্তত কিছু মাত্রায় মুসলিমদের মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় কেন্দ্র সংরক্ষণের পথ ছিল; অথচ হিন্দু রাষ্ট্রব্যবস্থায় সে সুযোগ ছিল না। একইভাবে মুসলিম জগতের কিছু ইসলামী দল গণতান্ত্রিক পথ ব্যবহার করে ইসলামী মূল্যবোধ ও ব্যবস্থাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। তারা আদালতে মামলা দায়ের করে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে, সরকারকে চাপ দেয়। তাদের নিকট গণতন্ত্র এ ক্ষেত্রে সামরিক স্বৈরতন্ত্র বা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার তুলনায় কিছুটা সুবিধাজনক। তবে যদি কেউ ইসলামকে প্রতিদ্বন্দ্বী করে গণতন্ত্র বা সেক্যুলারিজমের জয়ধ্বনি তোলে, তবে তা নিরেট কুফর। কেননা কিছু সেক্যুলার দল প্রকাশ্যেই ইসলামকে কেবল ব্যক্তিগত জীবনে সীমিত ধর্ম মনে করে, একে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ব্যবস্থা মানে না; তারা মুক্ত সংসদীয় গণতন্ত্র চায়, যেখানে হক-বাতিলের মানদণ্ড কেবল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত।