ইসলামি ইমারাতের বিরুদ্ধে দাঈশি খারিজিদের প্রোপাগাণ্ডা ও আপত্তিসমূহের শরঈ বিশ্লেষণ | নবম পর্ব

✍🏻 মৌলভী আহমাদ আলী

মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সহযোগিতা করার প্রসঙ্গে ইমাম মুহাম্মাদ রহিমাহুল্লাহর মতামত

ফিকহে হানাফির অন্যতম মহান ইমাম, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ১৮৯ হি.), যিনি খ্যাতিমান ইমাম এবং অসংখ্য সালাফে সালেহীনের শিক্ষক ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন: “আমি চাইলে বলতে পারি, কুরআন যেন মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানের ভাষাতেই নাযিল হয়েছে, কারণ তাঁর বাগ্মিতার কারণে এ কথাটি বলা যায়।”

ইমাম মুহাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ আস-সিয়ারুল কবীরের পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৪–এ বলেন—
بَابٌ، الْعَيْنُ يُصِيبُهُ الْمُسْلِمُونَ – قَالَ: وَإِذَا وَجَدَ الْمُسْلِمُونَ رَجُلًا مِمَّنْ يَدَّعِي الْإِسْلَامَ عَيْنًا لِلْمُشْرِكِينَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ يَكْتُبُ إلَيْهِمْ بِعَوْرَاتِهِمْ، فَأَقَرَّ بِذَلِكَ طَوْعًا، فَإِنَّهُ لَا يُقْتَلُ، لِأَنَّهُ لَمْ يَتْرُكْ مَا بِهِ حَكَمْنَا بِإِسْلَامِهِ، فَلَا نُخْرِجُهُ مِنْ الْإِسْلَامِ فِي الظَّاهِرِ مَا لَمْ يَتْرُكْ مَا بِهِ دَخَلَ فِي الْإِسْلَامِ، وَلِأَنَّهُ إنَّمَا حَمَلَهُ عَلَى مَا صَنَعَ الطَّمَعُ، لَا خُبْثُ الِاعْتِقَادِ، وَهَذَا أَحْسَنُ الْوَجْهَيْنِ، وَبِهِ أُمِرْنَا قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: ﴿فَيَتَّبِعُوْنَ اَحْسَنَهٗ﴾

وَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ: “لَا تَطْلُبَنَّ بِكَلِمَةٍ خَرَجَتْ مِنْ فِي أَخِيك سُوءًا وَأَنْتَ تَجِدُ لَهَا فِي الْخَيْرِ مَحْمَلًا”.

وَاسْتُدِلَّ عَلَيْهِ بِحَدِيثِ حَاطِبِ بْنِ أَبِي بَلْتَعَةَ، فَإِنَّهُ كَتَبَ إلَى قُرَيْشٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ يَغْزُوكُمْ فَخُذُوا حِذْرَکم.

فَلَوْ كَانَ بِهَذَا كَافِرًا مُسْتَوْجِبًا لِلْقَتْلِ مَا تَرَكَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ، بَدْرِيًّا كَانَ أَوْ غَيْرَ بَدْرِيٍّ.

وَكَذَلِكَ لَوْ لَزِمَهُ الْقَتْلُ بِهَذَا حَدًّا مَا تَرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ إقَامَتَهُ عَلَيْهِ.

وَفِيهِ نَزَلَ قَوْله تَعَالَى: ﴿يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا عَدُوِّىْ وَعَدُوَّكُمْ اَوْلِيَآءَ﴾.

فَقَدْ سَمَّاهُ مُؤْمِنًا، وَعَلَيْهِ دَلَّ قِصَّةُ أَبِي لُبَابَةَ حِينَ اسْتَشَارَهُ بَنُو قُرَيْظَةَ، فَأَمَرَّ أُصْبُعَهُ عَلَى حَلْقِهِ يُخْبِرُهُمْ أَنَّهُمْ لَوْ نَزَلُوا عَلَى حُكْمِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَتَلَهُمْ.

وَفِيهِ نَزَلَ قَوْلُهُ تَعَالَى: ﴿يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَخُوْنُوا اللّٰهَ وَالرَّسُوْلَ﴾
অনুবাদ: যদি মুসলিমরা এমন একজনকে পায়, যে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে কিন্তু বাস্তবে মুশরিকদের হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করে এবং তাদের কাছে মুসলিমদের গোপন খবর পৌঁছে দেয়, আর সে স্বেচ্ছায় তা স্বীকার করে, তবে তাকে হত্যা করা হবে না। কেননা, সে এখনও সেই মূল বিষয় ত্যাগ করেনি যার ভিত্তিতে আমরা তাকে মুসলিম বলে রায় দিয়েছিলাম। অতএব, সে ইসলাম থেকে বাহ্যত বহিষ্কৃত হবে না যতক্ষণ না সে সেই বিষয় ত্যাগ করে যেটির মাধ্যমে সে ইসলামে প্রবেশ করেছিল। আর প্রকৃতপক্ষে তাকে এ কাজে প্ররোচিত করেছে পার্থিব লোভ, আকীদাগত কোনো কুদৃষ্টি নয়। এটাই দুইটি মতের মধ্যে উত্তম মত, এবং আমাদেরকেও এ মতেই আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿فَيَتَّبِعُوْنَ اَحْسَنَهٗ﴾
“তারা এর উত্তম দিক অনুসরণ করে।”

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “তোমার মুসলিম ভাইয়ের মুখ থেকে যদি কোনো কথা বের হয় এবং তুমি সেটিকে উত্তম অর্থে নেওয়ার সুযোগ পাও, তবে কখনো তাকে খারাপ অর্থে নিয়ো না।”

এর প্রমাণ হিসাবে হাজিব ইবনু আবি বালতাআ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা উল্লেখ করা হয়। তিনি কুরাইশদের উদ্দেশে লিখেছিলেন: “রাসূলুল্লাহ ﷺ তোমাদের ওপর আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, তোমরা সাবধান হও।”

যদি এ ধরনের সহযোগিতার কারণে তিনি কাফের হয়ে যেতেন কিংবা হত্যার যোগ্য হতেন, তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ কখনো তাঁকে ছেড়ে দিতেন না, তিনি বদরী সাহাবী হোন বা না হোন। কেননা কুফর সবার জন্যই কুফর, কারও জন্য ব্যতিক্রম নয়। এমনকি যদি এ কাজের কারণে তাঁর ওপর হদ ওয়াজিব হতো, তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ তা কার্যকর করতে অবহেলা করতেন না। কারণ হদ আল্লাহর হক। যেমনটি অন্য এক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনায় এসেছে—কুরাইশরা এক মাখজূমি নারীর চুরির ঘটনায় চিন্তিত হলো। তারা বলল: “রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবে কে? তাঁর কাছে সাহস করে যেতে পারে একমাত্র উসামা ইবনু যায়েদ, যিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রিয়।” উসামা সুপারিশ করলে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: “তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমার বিষয়ে সুপারিশ করতে চাও?”
এরপর তিনি খুতবা দিলেন: “তোমাদের আগে যারা ধ্বংস হয়েছে, তার কারণ এই যে, যখন তাদের মধ্যে কোনো সম্মানিত ব্যক্তি চুরি করত, তারা তাকে ছেড়ে দিত; আর দুর্বল কেউ চুরি করলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করত। আল্লাহর শপথ, যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত, আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।”

হাতিব ইবনু আবি বালতাআ রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন:
﴿يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا عَدُوِّىْ وَعَدُوَّكُمْ اَوْلِيَآءَ﴾
“হে ঈমানদারগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধু বানিও না।”

এ আয়াতে হাতিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মুমিন বলেই সম্বোধন করা হয়েছে, যদিও তিনি কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করেছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হলো, তিনি কুফরে পতিত হননি, তাঁর ঈমান অটুট ছিল।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সহযোগিতা প্রসঙ্গে আবু লুবাবাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনাও দালিল। যখন বানু কুরায়যাহর ইয়াহুদিরা তাঁর কাছে পরামর্শ চাইল, তিনি তাঁর আঙুল গলার দিকে ইশারা করে জানালেন—“তোমরা যদি নবী ﷺ-এর হুকুমে আত্মসমর্পণ কর, তবে তিনি তোমাদের হত্যা করবেন।” এ ঘটনাও এক ধরনের সহযোগিতা ছিল, যদিও ইয়াহুদিরা এর থেকে কোনো সুফল নেয়নি।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করেন:
﴿يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَخُوْنُوا اللّٰهَ وَالرَّسُوْلَ﴾
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের সাথে খিয়ানত করো না।”
অতএব স্পষ্ট হলো—কোনো মুসলিম যদি কাফেরদের প্রতি ভালোবাসা বা সহযোগিতা প্রদর্শন করে, যারা ইসলামের বিরোধিতা করে, তা সঠিক নয়। যদিও তার সহযোগিতা থেকে মুসলিমদের বাস্তবিক কোনো ক্ষতি না-ও ঘটে।

Exit mobile version