ইসলামী ইমারাত পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পরাধীনতা, চাপ এবং বিদেশি প্রভাবের পরিধি থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে। এবার ইসলামী ইমারাত এমন এক কৌশল অবলম্বন করেছে যার কেন্দ্রবিন্দু হলো ইসলামী স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থ। এই পরিবর্তন গত বিশ বছরের নির্ভরশীলতা ও বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল নীতির বিপরীতে এক উজ্জ্বল ও নব দিকনির্দেশনা, যার লক্ষ্য আফগানিস্তানের প্রকৃত সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় করা। এই নতুন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে স্বাধীনতার চেতনার ওপর, যা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়সমূহে ভারসাম্য রক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়।
ইসলামী ইমারাত বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যা রাজনৈতিক বাস্তবতা ও পরস্পর বোঝাপড়ার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। আফগানিস্তান কোনো জোটের অংশ নয়, আবার কোনো শক্তির বিপক্ষে সংঘাতে লিপ্তও নয়; বরং পারস্পরিক সম্মান ও যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। চীন, রাশিয়া, ইরান, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের সম্প্রসারণ এই নীতির বাস্তব প্রতিফলন। এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান আফগানিস্তানকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অথচ নিরপেক্ষ ভূমিকার অধিকারী করেছে।
গত দুই বছরে ইসলামী ইমারাত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নতুন আস্থার এক অধ্যায় রচনা করেছে। ইরানের সঙ্গে পানি, বাণিজ্য ও অভিবাসী ইস্যুতে পারস্পরিক সম্মাননির্ভর পরিবেশ তৈরি করা, এবং চীন, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডোর ও বাণিজ্যপথ নির্মাণে অগ্রগতি অর্জন—এসবই সেই কৌশলের প্রধান সাফল্য। এই বাস্তববাদী ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান আঞ্চলিক দেশগুলোর পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি করেছে এবং আফগানিস্তানকে এক বিশ্বস্ত ও শান্তি-অভিলাষী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যা এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যের প্রতীক।
যদিও ইসলামী ইমারাত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেনি (রাশিয়া ব্যতীত), তথাপি বহু দেশের সঙ্গে বাস্তব রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্র ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। কাতার, রাশিয়া, চীন, ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরব এবং ইউরোপের কিছু দেশে ইসলামী ইমারাতের প্রতিনিধিদলগুলোর সফরই প্রমাণ করে যে, আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতা থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে তার রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই নীতি আফগানিস্তানের রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রতীক—কারণ ইমারাত কোনো চাপের সামনে নতি স্বীকার করেনি, বরং বৈধ ও কার্যকর সম্পর্কের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতার পথ তৈরি করেছে।
ইসলামী ইমারাত অর্থনৈতিক কূটনীতির শক্তিবৃদ্ধিতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু এখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তি। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে অংশগ্রহণ, উজবেকিস্তানের সঙ্গে রেলপথ চুক্তি, এবং ইরানের মাধ্যমে চাবাহার বন্দর সংক্রান্ত সহযোগিতার আলোচনাই বাস্তবভিত্তিক কূটনীতির প্রতিফলন। এই প্রকল্পগুলো কেবল আফগানিস্তানের অর্থনীতির জন্য নয়, বরং আঞ্চলিক সংযোগ ও পারস্পরিক উন্নয়নের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ইসলামী ইমারাত আঞ্চলিক দেশগুলোর আস্থা অর্জনে সফল হয়েছে। কারণ আফগান ভূমি কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি। এই নীতি অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আফগানিস্তানের গঠনমূলক ভূমিকা প্রতিফলিত করে। মধ্য এশীয় দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান আস্থা ও চীনের উদ্বেগের হ্রাস এই নীতিরই ফলাফল। এই প্রজ্ঞাপূর্ণ কৌশলই আফগানিস্তানকে এক বিপদসঙ্কুল ভৌগোলিক এলাকা থেকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সেতুতে রূপান্তরিত করেছে।
সাংস্কৃতিক ও ইসলামি ক্ষেত্রে ইসলামী ইমারাত ইসলামী পরিচয় রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন, উম্মাহর ঐক্যের বার্তা, এবং পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান—এই মূল্যবোধসমূহ ইসলামী ইমারাতের পররাষ্ট্রনীতিকে আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদান করেছে। এটি উম্মাহর চেতনার প্রতিধ্বনি, যা আফগানিস্তানকে পুনরায় এক স্বাধীন ও স্বনির্ভর ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
ইসলামী ইমারাত তার অঙ্গীকার পূরণে এবং বৈশ্বিক আস্থা পুনর্গঠনে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাদক চাষ রোধ, সন্ত্রাসবাদবিরোধী স্পষ্ট কার্যক্রম, এবং জাতীয় নিরাপত্তার সংহতি—এসব উদ্যোগ বিশ্বকে ইসলামী ইমারাতের ইতিবাচক মনোভাবের দিকে আকৃষ্ট করেছে। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার বিস্তারও এই ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী।
ইমারাতের পররাষ্ট্রনীতি জাতির মর্যাদানির্ভর। কোনো দেশের কাছে স্বীকৃতি বা ভিক্ষার নীতি গ্রহণ করা হয়নি; বরং এক স্বাধীন জাতির সম্মান ও গৌরব সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এটি আফগান জাতির জন্য মর্যাদা ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার এক নতুন অধ্যায়—যা বিশ্বকে দেখিয়েছে যে, আফগানিস্তান পরের সম্পদে নয়, বরং নিজের সংকল্প ও আত্মবিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত। এটি সেই সব জাতির জন্যও এক অনুপ্রেরণা, যারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করতে চায়।
আজ ইসলামী ইমারাত বিশ্বের বহু দেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের দ্বারপ্রান্তে। এর পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বাস্তববাদ, স্বাধীনতা, অর্থনীতি ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর। এই নীতি শুধু আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা নয়, বরং অঞ্চলজুড়ে শান্তি, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সংহতির এক নব সম্ভাবনার দুয়ারও উন্মোচন করেছে। ইসলামী ইমারাত এক স্বাধীন, ভারসাম্যপূর্ণ এবং নীতিনিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক মর্যাদাসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাবান জাতি হিসেবে তার স্থান পুনরুদ্ধার করছে।