পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এক রহস্যময় ছায়ারূপ ধারণ করে পুনরায় তাদের প্রাচীন ষড়যন্ত্রের নাট্যপট মঞ্চস্থ করছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো জাতীয় ও ধর্মীয় মহলকে টার্গেট করে এক অস্থির ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যেখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বরেণ্য ব্যক্তিত্বগণ, আর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে দেওয়া হয় সমাজের প্রতিটি স্তরে। উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ জিইয়ে রাখা, যাতে তারা অভ্যন্তরীণ বিবাদে লিপ্ত থেকে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র অনুধাবন করতে অপারগ হয়।
পাকিস্তানি জনমানসে এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কখনো দেওবন্দি উলামায়ে কেরামের ওপর আঘাত হানে, কখনো আহলুল হাদীস মতাদর্শের শায়খদের নিশানা করে। কখনো আবার তাদের নানাবিধ চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতার আবহ তৈরি করা হয়, যেন তারা সমাজে দাওয়াত ও সংস্কারের কাজ পরিচালনায় দুর্বল হয়ে পড়ে। অতঃপর, এ সকল হত্যাকাণ্ডের দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয় তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (TTP) কিংবা অন্য কোনো সশস্ত্র সংগঠনের ওপর, যাতে প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীরা নেপথ্যে থেকেই নিজেদের অপকর্ম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারে।
অতিসম্প্রতি শা‘বান মাসের শেষ জুমাবারে পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ দেওবন্দি প্রতিষ্ঠান জামিয়া দারুল উলুম হাক্কানিয়া আকোড়া খাটক-এর সহকারী পরিচালক মাওলানা হামিদুল হক রহিমাহুল্লাহকে নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করা হয়। হত্যাকারীদের পরিচয় সুস্পষ্ট; দাঈশী খাওয়ারিজ মতাদর্শের অনুগামীরা, যাদের পৃষ্ঠপোষকতা কারা করছে, সেটিও গোপন নয়। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই আহলুল হাদীসের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম শায়খ আমিনুল্লাহ পেশাওয়ারী হাফিজাহুল্লাহকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়, এবং চিরাচরিত কৌশল অনুসারে এর দায় TTP-এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
ঠিক একই ছকে জেলা কুরমে শিয়া-সুন্নি সংঘাতকে ইন্ধন দেওয়া হয়, যেন সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার আগুন এক মুহূর্তের জন্যও নিভে না যায়। সাধারণ নিরপরাধ জনতাকে হত্যা করে, সমাজের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে এই ষড়যন্ত্র-নাটকের কুশীলবরা তাদের নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করছে।
রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের অন্তরালে বিদ্যমান মূল লক্ষ্যসমূহ
১. দেওবন্দি, আহলুল হাদীস, সুন্নি ও শিয়া গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক বিষাক্ত করে তোলা, যাতে তাদের ঐক্য বিনষ্ট হয়।
২. মতপার্থক্যের পরিধিকে প্রশস্ত করে সংঘাতের এক অনিবার্য পরিবেশ তৈরি করা।
৩. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে যেসব শক্তি নিজেদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করছে, তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
এ ষড়যন্ত্রের শেকড় বহু গভীরে প্রোথিত। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সুদূরপ্রসারী কৌশলে এজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত এবং আন্তর্জাতিক ইয়াহুদি-সিহোনি লবির প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায় তারা ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে টার্গেট করছে, যাতে মুসলিম উম্মাহর অবশিষ্ট শক্তিগুলো পরস্পর বিরোধে লিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে।
আহলুল হাদীস ব্যক্তিত্বদের হত্যার দীর্ঘ ইতিহাস
১৯৮০-এর দশকে পাকিস্তানে আহলুল হাদীস মতাদর্শের ছয়জন প্রধান নেতা, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ আল্লামা আহসান ইলাহী জহির রহিমাহুল্লাহ এবং আরও প্রায় একশত কর্মী, এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ড কার নির্দেশে সংঘটিত হয়েছিল? তৎকালীন সময়ে কি তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (TTP)-এর অস্তিত্ব ছিল?
এবং আজ যখন সালাফি আলেম শায়খ আমিনুল্লাহ পেশাওয়ারী হাফিজাহুল্লাহ হত্যার হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন, তখন TTP নিজেই এক বিবৃতিতে একে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছে।
দেওবন্দি আলেমদের বিরুদ্ধে একই চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি
পাকিস্তানে দেওবন্দি চিন্তাধারার চারটি প্রধান সংগঠন রয়েছে—
১. জমিয়াত উলামায়ে ইসলাম
২. জামাআত ইশাআতুত তাওহিদ ওয়াস সুন্নাহ
৩. সিপাহ সাহাবা
৪. তাহরীক তাহাফফুজে খতমে নবুওত
এই সংগঠনগুলোর বহু প্রভাবশালী আলেম রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। সিপাহ সাহাবা ও তাহরীক তাহাফফুজে খতমে নবুওতের পুরো নেতৃত্বকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে, যা ইতিহাসের এক নির্মম দলিল।
১. মাওলানা ড. হাবিবুল্লাহ মুখতার শহীদ
২. মাওলানা মুফতি আবদুস সামি শহীদ
৩. মুফতি আবদুল মজিদ দিনপুরি শহীদ
৪. মুফতি সালেহ মুহাম্মদ কারোড়ি শহীদ
৫. মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানভি শহীদ
৬. ড. মুফতি নিজামুদ্দিন শামযাই শহীদ
৭. মুফতি মুহাম্মাদ জামীল খান শহীদ
৮. মাওলানা নাজির আহমাদ তুনসাভি শহীদ
৯. মাওলানা সাঈদ আহমাদ জালালপুরি শহীদ
ব্রেলভি আলেমদের হত্যাকাণ্ডও একই ষড়যন্ত্রের অংশ
১. ২০০৬ সালে করাচির নিশতার পার্কে ঈদে মিলাদুন্নবীর সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণ— ৬০ জন আলেম ও শতাধিক কর্মী নিহত।
২. ফৈজাবাদ ও করাচিতে তেহরিক লাব্বাইক পাকিস্তানের কর্মীদের ওপর হামলা, গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ।
উপসংহার
এতসব ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ধর্মীয় মহলকে টার্গেট করে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ব্রতী হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই— মুসলিম সমাজে বিভক্তির দেয়াল আরও উঁচু করে তোলা, যাতে তারা অভ্যন্তরীণ সংঘাতে লিপ্ত থাকে এবং প্রকৃত শত্রুর চেহারা চিনতে ব্যর্থ হয়।
তবে ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামের সত্যিকারের অনুসারীরা কখনোই এই চক্রান্তের শিকার হয়ে নিজেদের পথচ্যুত হয়নি। বরং তারা সবসময় সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
ফুঁ দিয়ে এই চেরাগ নিভানো যাবে না!