নিত্যনতুন উন্নয়ন ও রূপবদল এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ

বিশ্লেষণ: নু’মান সাঈদ

মধ্যপ্রাচ্য আজ এমন এক মৌলিক রূপান্তরের সাক্ষী, যা প্রথাগত সংঘাতের সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে হয়তো এই অঞ্চলের প্রভাববলয়ের মানচিত্রকে পুনর্গঠিত করতে চলেছে। এই পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পরিসর পর্যন্ত “যৌথ সার্বভৌমত্ব” (Shared Sovereignty) নামক একটি নতুন পরিভাষা উঠে এসেছে। এটি কেবল একটি শব্দ নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব যা এখন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

এই তত্ত্ব থেকে মনে হচ্ছে, এই অঞ্চল এখন একটি নতুন ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এমন এক ব্যবস্থা যেখানে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, ইরান এবং মিশর—এই অঞ্চলের সকল প্রধান শক্তি আঞ্চলিক বিষয়গুলো যৌথভাবে পরিচালনা করবে। তবে এই অংশীদারিত্ব এমনভাবে সাজানো হবে যে, এটি রাশিয়া এবং চীনের সমর্থন পাবে, এবং ইসরায়েল একটি অধীনস্থ সত্তা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে, কোনো কর্তৃত্বশীল শক্তি হিসেবে নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই তত্ত্ব কতটা বাস্তবসম্মত? কোন উপাদানগুলো এর পক্ষে কাজ করছে? কোন প্রতিবন্ধকতাগুলো এর বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, মুসলিম উম্মাহ কেবল অনুগামী না হয়ে কীভাবে এই রূপান্তর থেকে সর্বাধিক সুফল আহরণ করতে পারে?

এই তত্ত্বের ভিত্তিমূল
মধ্যপ্রাচ্য কি সত্যিই এক নতুন ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে?
“যৌথ শাসনব্যবস্থা” তত্ত্বের প্রবক্তারা কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণকে এর পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন—
১. আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিকটবর্তী হওয়া:
গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন। চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের পুনর্মিলন, তুরস্ক ও মিসরের সম্পর্কোন্নয়ন—যা দ্বন্দ্ব হ্রাস ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত বহন করে।
২. আমেরিকান প্রভাববলয়ে অবক্ষয়:
যুক্তরাষ্ট্রের ধীরে ধীরে এ অঞ্চল প্রত্যাহারের নীতি ও চীন-রাশিয়ার প্রতি কৌশলগত মনোযোগ আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে নিজেদের অগ্রাধিকারের পুনর্গঠন ও স্বনির্ভর জোট গঠনের সুযোগ দিয়েছে।
৩. রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা বৃদ্ধি:
ব্রিকস চুক্তি বা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর মাধ্যমে এ অঞ্চলে এক নতুন অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক কাঠামো গঠনের প্রয়াস চলছে, যা পশ্চিমের দীর্ঘস্থায়ী একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটাতে পারে।
৪. নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় প্রসার:
ভারতকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে যুক্তকারী অর্থনৈতিক করিডোরের মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে দায়িত্ববণ্টনের ধারণাকে শক্তিশালী করছে, যেন সামগ্রিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়।
৫. ইসরায়েলের অবস্থান পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা:
ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসন, সীমান্ত লঙ্ঘন, গোলানে সম্প্রসারণ ও সিরিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহে প্রভাব বৃদ্ধি—সবই ইঙ্গিত দেয় যে, দেশটি বুঝতে পারছে সে আর পশ্চিমের প্রাধান্যপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদার নয়; তাই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার আগে নিজের প্রভাব আরোপের শেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ
এই তত্ত্ব বাস্তবে রূপ নেয়া কঠিন কেন?
এই ইতিবাচক লক্ষণগুলোর পরও কিছু গুরুতর প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান—
৬. ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা:
যদিও সাধারণ স্বার্থ আছে, কিন্তু ইরান-সৌদি আরব, তুরস্ক-মিসর—এই জুটিগুলোর মধ্যে গভীর মতভেদ এখনো অবসান হয়নি; তারা সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাক ও সুদানের মতো অঞ্চলে এখনো প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
৭. ঐক্যবদ্ধ কাঠামোর অভাব:
এখনো পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট কাঠামো নেই যা এই দেশগুলোর সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এমনকি ব্রিকসও ব্যাপক অংশগ্রহণ সত্ত্বেও একটি শিথিল জোট হিসেবেই বিবেচিত।
৮. পশ্চিমা প্রভাবের ধারাবাহিকতা:
যদিও মার্কিন প্রভাব কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত, তবু সামরিক ঘাঁটি, অর্থনৈতিক শক্তি ও কূটনৈতিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এখনো এমন শক্তি, যা পশ্চিমবিরোধী যে কোনো নতুন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে সক্ষম।
৯. ইসরায়েলের অবস্থান:
ইসরায়েলের পক্ষে একটি প্রভাবশালী শক্তি থেকে অধীনস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া আপাতদৃষ্টিতে অকল্পনীয়, কারণ সে এমন কোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলবে যা তার কৌশলগত কর্তৃত্বকে হ্রাস করে।
১০. আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা:
অঞ্চলের বহু বড় শক্তিই নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত, যা তাদের দীর্ঘস্থায়ী নেতৃত্ব প্রদানের উপযুক্ত করে না।

উম্মাহ কীভাবে এসব রূপান্তর থেকে উপকৃত হতে পারে?
“যৌথ শাসনব্যবস্থা” বাস্তব হোক বা তত্ত্বমাত্র থাকুক, মূল প্রশ্ন হলো—মুসলিম উম্মাহ কিভাবে এই পরিবর্তনগুলোর কেবল অনুসারী না হয়ে, সেগুলো থেকে বাস্তব সুফল আহরণ করতে পারে।
১. কৌশলগত চেতনা বিকাশ:
গভীর ভূরাজনৈতিক বোধ ছাড়া এই পরিবর্তনের মোকাবিলা সম্ভব নয়। তাই গবেষণা ও বিশ্লেষণকে জোরদার করতে হবে—যেখানে শক্তি ও প্রভাবের প্রকৃত গতিবিধি বিশ্লেষণ করা হয়।
২. অর্থনৈতিক শক্তি সংহত করা:
আঞ্চলিক জোটের ফলাফলের অপেক্ষা না করে, ইসলামি দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে প্রকৃত অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে এবং বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।
৩. প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা গড়ে তোলা:
বাস্তব সার্বভৌমত্ব কেবল তখনই সম্ভব যখন উৎপাদন, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে স্বনির্ভরতা অর্জিত হয়। এর অনুপস্থিতি মানে আত্মবিনাশের দিকে পদক্ষেপ।
৪. আত্মসমর্পণ ও হতাশার মানসিকতা ভাঙা:
এই ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে যে মুসলিম উম্মাহ নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে অক্ষম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—নেতৃত্ব তাদেরই, যারা পরিবর্তন আনে, প্রতিক্রিয়া নয়।
৫. একচ্ছত্র মনোভাব থেকে মুক্তি:
পরিবর্তনকে “সম্পূর্ণ ব্যর্থতা” বা “সম্পূর্ণ সাফল্য” হিসেবে না দেখে, আংশিক সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে অগ্রসর হতে হবে।

সম্ভাব্য দৃশ্যপট ও উম্মাহর শ্রেষ্ঠ বিকল্প
আমরা কয়েকটি সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি—
• যদি “যৌথ শাসনব্যবস্থা” বাস্তব রূপ নেয়, তবে উম্মাহকে সতর্ক দূরদর্শিতার সঙ্গে এতে প্রবেশ করতে হবে, যাতে এটি নতুন কোনো আঞ্চলিক সাম্রাজ্যে পরিণত না হয়।
• যদি এটি ব্যর্থ হয় এবং পশ্চিমা আধিপত্য টিকে যায়, তবে বিকল্প হতে হবে ইসলামী ঐক্য—যা বৈশ্বিক দ্বিধাবিভক্তি থেকে মুক্ত থেকে সত্যিকারের সার্বভৌম অবস্থান গড়ে তুলবে।
• আর যদি ইসরায়েল অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগে নিজের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, তবে সেই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রত্যেক আঞ্চলিক দেশ ও সংগঠনের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত—কারণ এটি বৃহত্তর জায়নবাদী আধিপত্যের এক নবরূপ।

সারকথা: অপেক্ষা নয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণ
আমরা “নতুন মধ্যপ্রাচ্য”-এর উদ্ভব প্রত্যক্ষ করব কি না—তা নির্বিশেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আমরা কি ভবিষ্যৎ নির্মাণের অংশীদার হব, না কেবল আরোপিত বাস্তবতা মেনে নেওয়া দর্শক?

বড় পরিবর্তন কখনো নিয়তি নয়, এগুলো বিভিন্ন শক্তির পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফল। আর এসব রূপান্তরের চূড়ান্ত দিক নির্ধারণ করে তারা—যাদের আছে চেতনা, ইচ্ছাশক্তি ও কার্যক্ষমতা।

সম্ভবত এই চ্যালেঞ্জগুলোই আমাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। আমরা যেন বৈশ্বিক ব্যবস্থার ভেতরে উম্মাহর অবস্থান নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। কিন্তু তা কেবল সম্ভব হবে যদি আমরা স্লোগান ও আবেগ নয়, পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দর্শনের মাধ্যমে অগ্রসর হই। ইতিহাস রচনা তারা রচনা করে না, যারা চ্যালেঞ্জকে দেখে; বরং তারা—যারা সেই চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তরিত করে নিজেদের স্বার্থে বিশ্বপরিপ্রেক্ষিত পুনর্গঠিত করে।

Exit mobile version