যদিও ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে কোনো স্থলসীমা নেই, তবে এই দু’টি দেশের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু পাকিস্তান বরাবরই এই সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখেছে এবং আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা সীমিত করতে সচেষ্ট থেকেছে।
পাকিস্তানের এই সংকীর্ণ নীতি কেবল তাদের কূটনৈতিক মঞ্চে ব্যর্থতার কালিমা এঁকে দেয়নি, বরং আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককেও বহুমুখী জটিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করেছে। সম্প্রতি দুবাইয়ে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরির মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক এ প্রেক্ষাপটেরই বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই বৈঠক ভারত ও আফগানিস্তান সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে এবং পাকিস্তানের জন্য আরেকটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পাকিস্তানের আফগান নীতি বরাবরই দ্বিচারিতা ও দূরদর্শিতার অভাবে কলঙ্কিত। উনিশ শতকের শেষভাগে ইসলামাবাদ যখন তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল, তখন তাদের প্রত্যাশা ছিল, ভবিষ্যতেও তালেবান শাসনের ওপর তারা প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হবে। তবে ২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর তাদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির দৃঢ় ঘোষণা ইসলামাবাদের সেই প্রত্যাশাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।
ফলস্বরূপ, আফগান শরণার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং ডুরান্ড লাইনের ওপারে হামলাকারীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ইসলামী ইমারতের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা এবং আফগান ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালানোর পর, বিশেষ করে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কাবুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ভুল হলো আফগানিস্তানকে তাদের তথাকথিত কৌশলগত গভীরতার দর্শনের আলোকে পর্যালোচনা করা এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এর মর্যাদাকে অবহেলা করা।
অপরদিকে, ভারত সবসময় আফগানিস্তানের উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং মানবসম্পদের উন্নয়নে নিবেদিত থেকেছে। ভারত আফগান জনগণের জন্য বৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি সড়ক ও হাসপাতাল নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অগ্রগামী থেকেছে। এই বৈপরীত্য আজ আরও গভীরভাবে দৃশ্যমান— পাকিস্তান যেখানে তালেবানের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ভারতের কূটনৈতিক দিগন্ত উন্মুক্ত রয়েছে।
দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠকটিকে শুধুমাত্র একটি প্রথাগত কূটনৈতিক বিনিময় হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এই বৈঠকের মাধ্যমে ইসলামী ইমারত স্পষ্ট করেছে যে, তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত। আলোচনায় কূটনীতি, অর্থনীতি ও বাণিজ্য ছাড়াও নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। এটি ইসলামী ইমারতের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং অঞ্চলে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণের ইচ্ছার প্রকাশ।
বিশেষত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা একটি প্রশংসনীয় কৌশল। ইসলামী ইমারত বুঝতে পেরেছে যে, কেবল এক বা দুই দেশের ওপর নির্ভরশীল হওয়া লাভজনক নয় বরং একটি বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময় পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করলে আফগানিস্তানের স্বার্থ অধিকতর সুরক্ষিত হবে। এ কারণেই তারা শুধু চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে না, বরং উপসাগরীয় দেশগুলো, ইরান এবং ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক শক্তিশালী করছে।
এখন পাকিস্তানের জন্য একটি অতি জরুরি প্রশ্ন হলো: তারা কি তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে, নাকি ঐতিহ্যবাহী ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব বজায় রেখে আফগানিস্তানে তাদের ক্রমহ্রাসমান প্রভাবকে আরও ত্বরান্বিত করবে? ইসলামী ইমারতের প্রতি চাপ সৃষ্টি বা কঠোর নীতি অবলম্বন কোনো ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না; বরং সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলবে।
ইসলামাবাদকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আফগানিস্তান একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র, যার নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে।
ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক উন্নয়ন কোনো ষড়যন্ত্র নয় বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা। পাকিস্তান যদি এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তাদের নীতিতে নমনীয়তা প্রদর্শন করে, তবে তারাও এই পরিস্থিতি থেকে উপকৃত হতে পারে। তবে যদি তারা ভারতের উপস্থিতিকে শত্রুতার দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে, তবে তা কেবল তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে।
দুবাইয়ের এই বৈঠক একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত। যদি আলোচনা ইতিবাচক গতিতে অগ্রসর হয়, তবে তা ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্ককে মজবুত করবে না, বরং আঞ্চলিক কূটনৈতিক ও কৌশলগত ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলবে। তালেবান সরকার ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় তাদের সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, এবং যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তবে আফগানিস্তান ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।