রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুদ্ধজীবন: মানবজাতির জন্য শিক্ষা

[দ্বিতীয় পর্ব]

✍🏻 আবু রাইয়ান হামিদী

যখন মুসলিমদের ওপর জিহাদের আদেশ অবতীর্ণ হলো, তখন এর সঙ্গে সূচনা হলো এক মহৎ আদর্শের, এক আলোকোজ্জ্বল তত্ত্বের— যা যুগে যুগে নিপীড়িত উম্মতকে মর্যাদার শিখরে পৌঁছে দিয়েছে এবং ইসলামের শত্রুদের বারংবার পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করিয়েছে।

সীরাত বিশারদদের মতে, যে সেনাবাহিনীতে রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং উপস্থিত থেকেছেন, তা গাযওয়া নামে পরিচিত, চাই সে যুদ্ধে সংঘর্ষ হোক বা না হোক। আর যে অভিযানে তিনি স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেননি, তাকে সারিয়াহ বা বাআস বলা হয়, চাই সে যুদ্ধে রক্তক্ষয় হোক বা না হোক।

গাযওয়া ও সারিয়াহর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। প্রখ্যাত সীরাতকার মুসা ইবনু উকবা, ইবনু ইসহাক, আল্লামা ওয়াকিদি ও ইবনু জাওযি (রহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখের মতে, রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় গাযওয়ার মোট সংখ্যা ছিল ২৭। অপরদিকে, সারিয়াহর সংখ্যা সম্পর্কে মতভেদ আরও বিস্তৃত, যেখানে অনেক সীরাতবিদের অভিমত ৩৮।

এ সকল গাযওয়া ও সারিয়াহ সংঘটিত হয় মাত্র দশ বছরের এক সীমিত সময়কালে— যা শুরু হয় রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হিজরতের বছর থেকে এবং তাঁর ওফাতের বছরে এসে সমাপ্ত হয়। গাযওয়ার এই ধারাবাহিকতার সূচনা হয়েছিল গাযওয়াতুল আবওয়া দিয়ে এবং সমাপ্তি ঘটে গাযওয়াতুত তাবুকে। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ জিহাদের নির্দেশ পালনে কীভাবে পূর্ণ আত্মনিবেদন প্রদর্শন করেছিলেন।

গাযওয়া ও সারিয়াহর সংখ্যা নিয়ে মতভেদ
গাযওয়া ও সারিয়াহর সংখ্যা নির্ধারণে মতবিরোধের মূল কারণ নিহিত সীরাতকারদের পর্যালোচনার ভিন্নতায়। কোনো কোনো আলিম একাধিক গাযওয়াকে একক অভিযানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, কারণ সেগুলো একই অভিযাত্রার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যদিকে, কিছু আলিম প্রতিটি ঘটনাকে আলাদা গাযওয়া হিসেবে গণ্য করেছেন এবং অভিযানের প্রতিটি ধাপকে পৃথকভাবে তালিকাভুক্ত করেছেন। এই মতভেদকে ঘিরে আরও নানা ব্যাখ্যা বিদ্যমান, তবে এখানে কেবল মৌলিক কারণগুলোকেই উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রথম গাযওয়া: (গাযওয়াতুল আবওয়া/ওয়াদ্দান)
আবওয়া এবং ওয়াদ্দান —এই দুটি স্থাননাম ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গাযওয়ার স্মৃতি বহন করে। এ অভিযানে রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং নেতৃত্ব দেন এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রায় সত্তরজন মুহাজির সাহাবি।

এই গাযওয়া সংঘটিত হয়েছিল হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষের সফর মাসে। তবে এখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা, যা সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে গমন করছিল। কাফেলাটি বনু দ্বামরাহ গোত্রের এলাকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। মুসলিম বাহিনী যখন ওয়াদ্দান পর্যন্ত পৌঁছায়, কাফেলাটি ততক্ষণে তাদের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে, বনু দ্বামরাহ গোত্র যুদ্ধের পথ পরিহার করে রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শর্ত ছিল নিম্নরূপ:
১. বনু দ্বামরাহ গোত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শত্রুতা প্রদর্শন করবে না।
২. তারা মুসলমানদের শত্রুদের কোনোভাবে সহায়তা করবে না।
৩. প্রয়োজনে তারা মুসলিমদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াবে।
৪. যতদিন তারা এই চুক্তি অক্ষুণ্ণ রাখবে, মুসলিমদের পক্ষ থেকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তবে চুক্তি ভঙ্গ করলে তারা এ সুবিধা হারাবে।

এই অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা প্রায় ১৫ দিন মদিনার বাইরে অবস্থান করেন। এ সময় রাসুলুল্লাহ ﷺ মদিনার শাসনভার অর্পণ করেন হযরত সা’দ ইবনু উবাদা রাদিয়াল্লাহু আনহুর ওপর।

এই গাযওয়া থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
ক. রাসুলুল্লাহ ﷺ শুধুমাত্র মসজিদের মিম্বরে কুরআন ও শরিয়তের বিধান প্রচার করেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের এক অভিজাত কুশলী সেনাপতি এবং সূক্ষ্ম যুদ্ধকৌশলের গভীর জ্ঞানসম্পন্ন নেতা। যুদ্ধের প্রতিটি দিক সম্পর্কে তাঁর পূর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতা ছিল, এবং প্রেক্ষাপটের প্রতি সুবিবেচনা রেখে তিনি প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্র এমন কৌশলে বিন্যস্ত করতেন যে শেষপর্যন্ত বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠত।

বনু দ্বামরাহ গোত্র মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী একটি কৌশলগত অবস্থানে ছিল, যা কুরাইশদের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থানকে ব্যবহার করে কুরাইশরা সুবিধা নিতে পারত। তাই রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের সঙ্গে এমন শর্তে শান্তিচুক্তি করেন, যাতে তারা কুরাইশদের যুদ্ধে সহায়তা না করে।

খ. রাসুলুল্লাহ ﷺ এর এই কাজ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কাফেরদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার অনুমতি শরিয়তে বিদ্যমান, যদি তা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হয়। এমন চুক্তি, যা মুসলমানদের বর্তমান বা ভবিষ্যতের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, শরিয়তের নীতিতে অনুমোদিত। এই গাযওয়ার প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ ﷺ বিভিন্ন সময়ে এই কৌশল অবলম্বন করেছেন।

তবে রাজনৈতিক চুক্তি গ্রহণের সময় মুসলিমদের অবস্থান অবশ্যই সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন এবং সেই চুক্তি অবশ্যই সমগ্র উম্মাহর স্বার্থ বিবেচনা করে করা উচিত। এমন চুক্তি করতে হবে, যা মুসলিমদের সম্মিলিত মঙ্গল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং কোনো পরিস্থিতিতেই মুসলিমদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না।

Exit mobile version