বেলুচিস্তানের বুকে যখন জাফর এক্সপ্রেস হামলার শিকার হলো, তখনই এক নির্দিষ্ট প্রোপাগান্ডার ঢেউ উঠল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে; গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল যে, এই হামলার ছায়াসূত্র আফগানিস্তানের মাটিতে প্রোথিত, পরিকল্পনার বীজ সেখানে বোনা হয়েছিল এবং মূল ষড়যন্ত্রকারীরাও সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে।
এই ভিত্তিহীন প্রচারণা ক্রমে রাষ্ট্রীয় বয়ানে রূপ নেয়। এমনকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও অনুরূপ বক্তব্য প্রদান করেন। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, পাকিস্তান বরাবরই নিজের ব্যর্থতার ভার অন্যের কাঁধে চাপানোর অভ্যাস লালন করেছে। এ যেন পাকিস্তানি সামরিক কৌশলের এক পুরোনো নাট্যরীতি— জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা, দিকভ্রান্ত রাখা।
দীর্ঘকাল ধরে পাকিস্তান এই দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছে যে, বেলুচ স্বাধীনতাকামীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে ভারত— যেখানে নয়াদিল্লি তাদেরকে কৌশলগত ও রাজনৈতিক সহায়তা প্রদান করছে। অথচ আজ সে একই অভিযোগের নিশানা আফগানিস্তানের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগের এই ভিত্তিহীন রূপরেখার অন্তরালে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেই মিথ্যার বুনন সৃষ্টি করছে, তার মূল কাঠামো গঠিত হয়েছে একটি “জনপ্রিয় রাষ্ট্রীয় বয়ান” ঘিরে! একটি বয়ান, যা গত দুই বছর ধরে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারিত হচ্ছে, যাতে নিজ ভূমিতে সংঘটিত সকল ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় এবং জনগণের অসন্তোষের তীর অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া যায়।
এছাড়াও আফগানিস্তানের অকাট্য ও প্রমাণসমৃদ্ধ বক্তব্যকে দুর্বল প্রমাণ করার জন্য পাকিস্তান “অভিযোগ-নীতি” গ্রহণ করেছে। তথ্যপ্রমাণ বলছে, হাজী খলিলুর রহমান শহীদ (রহিমাহুল্লাহ) এর ওপর হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল পাকিস্তানে এবং হামলাকারী প্রবেশ করেছিল বেলুচিস্তান থেকে আফগানিস্তানে।
একইভাবে কুন্দুজে কাবুল ব্যাংকের ওপর পরিচালিত হামলার নেপথ্যেও ছিল পাকিস্তানের মাটিতে গঠিত ষড়যন্ত্র এবং হামলাকারীর আগমনও সেই দিক থেকেই হয়েছিল। আফগানিস্তানে সংঘটিত অধিকাংশ জঙ্গি হামলার মূল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় সম্পন্ন হয়েছে। এই সমস্ত তথ্য পাকিস্তানকে অবহিত করা হয়েছিল, যথাযথ প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু তবুও, জাফর এক্সপ্রেসে হামলার পর পাকিস্তান পাল্টা দাবি তোলে যে, এর মূল ষড়যন্ত্রকারী অবস্থান করছিল আফগানিস্তানে।
দ্বৈত নীতির ছায়ায় আবৃত পাকিস্তান
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মাওলানা হামিদুল হক (রহিমাহুল্লাহ) এর ওপর দাঈশ (আইএস) কর্তৃক পরিচালিত হামলা পাকিস্তানের জন্য এক তীব্র অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে বেলুচিস্তানে দাঈশের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতার গ্রেফতারের পর পাকিস্তান তাদের অন্যতম শরীফুল্লাহকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয় এবং বাকি সদস্যদের নিয়ে ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার পথ খোঁজে। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের নীতির দ্বৈততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এবং তার বিরুদ্ধে দ্বিমুখী আচরণের অভিযোগ ওঠে।
দাঈশ-খোরাসানের অস্তিত্ব, পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান এবং এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর লেনদেন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আফগানিস্তান বহুবার বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছে। এ বিষয়টি পাকিস্তানের জন্য কেবল কূটনৈতিক চাপই সৃষ্টি করেনি, বরং তার রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ গতিবিধিকেও নড়বড়ে করেছে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, পাকিস্তান পাল্টা অভিযোগ এনে আফগানিস্তানকে দোষারোপের কৌশল নিয়েছে।
বাস্তবতা কী বলে?
পাকিস্তানের এই অমূলক অভিযোগের পক্ষে বাস্তবতার কোনো ভিত্তি নেই। এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই যা প্রমাণ করতে পারে যে, ইসলামী ইমারাত বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। বরং ইসলামী ইমারাতের আদর্শিক ও মতাদর্শগত কাঠামো বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। বেলুচ জাতীয়তাবাদ একটি নৃতাত্ত্বিক-জাতিগত আন্দোলন, যা ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণার বিপরীতে অবস্থান করে। অন্যদিকে ইসলামী ইমারাতের দৃষ্টিভঙ্গি দৃঢ়ভাবে ইসলামী আদর্শ ও নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
অতএব, পাকিস্তানের এই ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং কল্পিত বয়ানের পেছনে মূলত তিনটি বিষয় কাজ করছে—
১. নিজেদের ব্যর্থতা থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া,
২. পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দাঈশ-খোরাসানের ক্রমবর্ধমান কর্মকাণ্ড থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া,
৩. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে সুসংহত রাখা।
পাকিস্তানের এই রণনীতি এক দীর্ঘপ্রসারিত ছায়াযুদ্ধ; যেখানে মিথ্যা, বিভ্রান্তি ও অভিযোগের মাধ্যমে বাস্তব সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ইতিহাস সাক্ষী, মিথ্যার ওপর দাঁড় করানো যে কোনো প্রাসাদ একদিন ভেঙে পড়ে এবং সত্যের সূর্য একসময় উন্মোচিত হয়।