রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুদ্ধজীবন: মানবজাতির জন্য শিক্ষা | দশম পর্ব

✍🏻 আবু রাইয়ান হামিদী

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণের হাতে নির্মিত কূপের ধারে কাফির বাহিনীর কয়েকজন সদস্য জল আহরণের উদ্দেশ্যে আগমন করে। তবে সকলেই নিহত হয়, ব্যতিক্রম ছিল কেবল হাকীম ইবন হিযাম, যিনি সেখান থেকে প্রাণরক্ষা করে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পর যখনই তিনি শপথ করতেন, বলতেন “শপথ সেই সত্তার, যিনি বদরের দিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন।”

কুরাইশ নেতৃত্বভার অর্পণ করে দেয় উমাইর ইবন ওয়াহ্‌ব আল-জুহানীর ওপর, যাতে তিনি মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ও প্রস্তুতির হালচাল পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি চারপাশ প্রদক্ষিণ করে ফিরে এসে বললেন, “বাহিনীর সংখ্যা তিনশোর কিছু অধিক, এর বেশি নয়।” অতঃপর তিনি আরও অনুসন্ধানের জন্য উপত্যকার মধ্যে অশ্বারোহণ করে ঘোরাফেরা করতে থাকেন, যেন বুঝতে পারেন, গোপন কোনো ফাঁদ কিংবা সাহায্যকারী বাহিনী লুকিয়ে আছে কি না।

ফিরে এসে বললেন, “এই বাহিনী কারও সাহায্যপ্রাপ্ত নয়। তবে হে কুরাইশ! আমি এমন সব মুখাবয়ব দেখেছি, যেন মৃত্যুর দূত হয়ে এসেছে। মদিনার উট যেন সরাসরি মৃত্যু বহন করে এনেছে। আমি শপথ করে বলি, এদের প্রত্যে‌কে মৃত্যুবরণ করবে না, যতক্ষণ না তোমাদের কাউকে হত্যা করে। এদের আশ্রয়স্থল এদের তরবারি, এবং গূঢ় রহস্যও লুকিয়ে আছে সেই তরবারিতেই। কাজেই হে কুরাইশ! ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো।”

হাকীম ইবন হিযামের পরামর্শে ‘উতবা ইবন রাবি‘আ কুরাইশ বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানালেন। বললেন, “তোমরা মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো মর্যাদা অর্জন করতে পারবে না। যদি হত্যা করেও ফেলো, তাহলেও দেখবে— তোমরা এমন মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত করেছ, যেগুলো তোমাদের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে। প্রত্যেকেই নিজের প্রিয়জন পিতা, ভ্রাতা, চাচাতো ভাই কিংবা আত্মীয়কে নিধন করবে। তাই সর্বোৎকৃষ্ট পথ হচ্ছে, ফিরে যাও এবং মুহাম্মাদকে অন্য আরব গোত্রগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে দাও।”

উতবা বললেন, “হাকীম! তুমি যাও এবং আবু জাহলকে বলো, আমি ইবন হাযরামীর মিত্র, তাঁর সম্পদের যাবতীয় দায়ভার আমি গ্রহণ করছি।” (আবু জাহল কুরাইশকে উসকিয়ে দিতে বারবার ইবন হাযরামীর হত্যার কথা তোলে।)

যখন হাকীম আবু জাহলের নিকট গিয়ে উতবার বার্তা পৌঁছে দিলেন, তখন আবু জাহলের মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। সে বলল, “উতবা ভীত হয়ে পড়েছে! আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেন। আসলে তার পুত্র আবু হুযাইফাও তো মুহাম্মদের সঙ্গে রয়েছে— এটিই তাদের ভয়ভীতির মূল!”

উক্ত কথা যখন উতবার কানে পৌঁছল, তিনি বললেন, “আবু জাহল আমাকে ভীত বলছে?! এই প্রসাধনসিক্ত পশ্চাৎদেশধারী শিগগিরই জানতে পারবে ভয় কার হৃদয়ে লুকিয়ে রয়েছে!”

আবু জাহল, বিদ্রোহ যেন দানা না বাঁধে এই আশঙ্কায়, ইবন হাযরামীর ভ্রাতা ‘আমির ইবন হাযরামীকে বার্তা পাঠাল: “দেখো, তোমার মিত্র (উতবা) বাহিনীকে পিছিয়ে দিতে চায়, যখন এই মুহূর্তে প্রতিশোধ গ্রহণের সুবর্ণ সুযোগ এসেছে!”

‘আমির এই কথা শুনে উত্তেজনায় তাঁর পোশাক ছিঁড়ে ফেলে নগ্ন হয়ে উঠলেন এবং বাহিনীর মাঝে আহাজারি করে চিৎকার করতে লাগলেন—“হায় আমার ভাই! হায় আমার ভাই!”

এই আহ্বান কুরাইশ বাহিনীতে প্রবল আবেগের সঞ্চার ঘটাল। বুদ্ধিমত্তা বিলীন হয়ে গেল উন্মত্ততায়। উতবার প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ বিস্মৃত হয়ে, যুদ্ধের উদ্দীপনা আগুনের শিখার মতো জ্বলতে লাগল।

এই সময় মুশরিকদের কাতার থেকে আসাদ ইবন আবদুল আসাদ আল-মাখযূমী বেরিয়ে এল। তাঁর ঘোষণা ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: “আমি কূপ থেকে পানি পান করেই ছাড়ব, তা না হলে এই পথে প্রাণ বিসর্জন দেব!”

তাঁর মোকাবেলায় দাঁড়ালেন আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের সিংহ হযরত হামযাহ্‌ ইবন আব্দুল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু। একটি আঘাতেই তিনি আসদকে ভূমিতে ফেলে দেন। কিন্তু আসাদ চলতে থাকে, অবশেষে হামযাহ্‌ রাদিয়াল্লাহু আনহুর দ্বিতীয় আঘাত তাকে অনন্ত নিদ্রায় শায়িত করে দেন।

আবু জাহলের কটুক্তি উতবাকে বাধ্য করে মাঠে নামতে। তিনি তাঁর ভ্রাতা শায়বা এবং পুত্র ওলীদকে সঙ্গে নিয়ে বাহিনী থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বললেন: “هَلْ مِنْ مُبَارِز؟” —“কেউ কি রয়েছে মোকাবেলায়?”

মুসলিম বাহিনী থেকে এগিয়ে এলেন তিনজন আনসার সাহাবী— আউফ, মু‘আওয়িয ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

মুশরিকরা জানতে চাইল, “তোমরা কারা?”

তারা বললেন, “আমরা আনসারদের অন্তর্ভুক্ত।”

মুশরিকরা বলল, “আমাদের তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ–কে সম্বোধন করে বলল, “হে মুহাম্মাদ! আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য আমাদেরই সমকক্ষ কাউকে পাঠাও।”

রাসূলুল্লাহ ﷺ ঘোষণা করলেন: “হামযাহ্‌, আলী ও উবাইদা ইবন হারিস! তোমরা এগিয়ে আসো।”

তাঁরা অগ্রসর হলেন। মুখে পর্দা থাকায় মুশরিকরা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কে?”

তাঁরা পরিচয় দিলে মুশরিকরা বলল, “তোমরাই উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।”

উবাইদা ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনি উতবার মোকাবেলায় গেলেন; হামযাহ্‌ গেলেন শায়বার বিরুদ্ধে এবং আলী গেলেন ওলীদের সঙ্গে। যুদ্ধ শুরু হলো। আলী ও হামযাহ্‌ শত্রুদের ত্বরিতভাবে নিধন করলেন। উবাইদা ও উতবার মধ্যকার লড়াই ছিল দীর্ঘ ও তীব্র, দু’জনেই রক্তাক্ত হলেন, এমনকি উবাইদার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

আলী ও হামযাহ্‌ এসে উতবাকে হত্যা করলেন এবং উবাইদাকে নবীজীর কাছে নিয়ে এলেন।

এই যুদ্ধে উবাইদা এতটাই আহত হন যে, মদিনায় প্রত্যাবর্তনের পথে ‘সাফরা’ নামক স্থানে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

এই মহিমান্বিত সংঘর্ষের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ কুরআনে বলেন:

﴿هَذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِمْ فَالَّذِينَ كَفَرُوا قُطِّعَتْ لَهُم ثِيَابٌ مِنْ نَارٍ يُصَبُّ مِنْ فَوْقِ رُءُوسِهِمُ الْحَمِيمُ﴾ (الحج: 19)

“এই দুই পক্ষই ছিল তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত। অতঃপর যারা কুফর করেছে, তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আগুনের পোশাক, এবং তাদের মাথার ওপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি।”

যখন উবাইদা নবীজীর সামনে উপস্থিত হলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কি শহীদ?” নবীজি বললেন, “أشهد أنك شهيد”
—“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি শহীদ।”

এই পূণ্যময় মুহূর্তে উবাইদা তাঁর অন্তিম কাব্যগুচ্ছ উচ্চারণ করলেন—

فَإِن یَقطَعُوا رِجْلِي فَإِنِّي مُسْلِمٌ
أَرْجُو بِهِ عِیشاً مِّنَ اللَّهِ سَالِمَا
وَأَلْبَسَنِي الرَّحْمٰنُ مِنْ فَضْلِهِ
لِبَاسًا مِّنَ الإِسْلَامِ غَطَّی المَسَاوِیَا

“যদি আমার পা কেটে ফেলা হয়, তবু আমি মুসলিম
আল্লাহর করুণায় শান্তিময় জীবনের আশায় উদ্দীপ্ত।
রহমান আমাকে নিজ অনুগ্রহে পরিধান করিয়েছেন ইসলামের বস্ত্র,
যা আবৃত করে দিয়েছে আমার সকল ত্রুটিকে।”

Exit mobile version