যখন মুশরিকরা তাদের তিনজন দক্ষ সেনানায়ককে হারাল, তখন তারা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। নিহত নেতাদের প্রতিশোধ নেওয়ার উন্মাদনা তাদের অন্তরে হিংসার আগুনকে আরও দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিল। যখন মুখোমুখি দ্বন্দ্বে তিনজন মুশরিক নিহত হলো, তখন আবু জাহল তার সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ করে বলল, “তারা চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছে। আল্লাহর কসম! আমরা তাদেরকে ছেড়ে দেব না যতক্ষণ না তাদের পায়ে রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যাই।”
অতঃপর সে সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক আক্রমণের নির্দেশ দেয়। পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুসলিমরা তাদের উপর তীরের বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করে। মুসলিমদের জিহ্বা ছিল “আহাদ, আহাদ”–এর যিকিরে ভেজা। তাঁরা অবিচলভাবে তাদের স্থান আঁকড়ে ধরে ছিল। যখন কাফিরদের সেনাবাহিনী নিকটে এসে পৌঁছে, তখন মুসলিমরা তাদের উপর তীব্র আক্রমণ চালায় এবং বড় ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।
সুশৃঙ্খল সারিবিন্যাস ও সংগঠিত নেতৃত্বের পর, সেনাপতি ﷺ তাঁর তাবুতে চলে গেলেন এবং আসমান ও যমিনের অধিপতির কাছে নিবেদন শুরু করলেন। তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে ঝলমলে অশ্রুপাতসহ তাঁর বাহিনীর জন্য এইভাবে বিজয়ের দোআ করতে লাগলেন:
”اللهم أنجز لي ما وعدتني، اللهم إن تهلك هذه العصابة من أهل الإسلام فلا تعبد في الأرض أبدا“
অনুবাদ: হে আল্লাহ! আপনি যে প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন, তা পূর্ণ করুন। হে আল্লাহ! যদি এই মুষ্টিমেয় মুসলিম ধ্বংস হয়ে যায়, তবে এই পৃথিবীতে আর কেউ আপনার ইবাদত করবে না।
এই প্রার্থনা ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ না রাসুলুল্লাহ ﷺ–এর কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যায়। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই চাদর তুলে তাঁর কাঁধে পুনরায় রাখেন এবং আরয করে বলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! এখন যথেষ্ট হয়েছে। নিশ্চয়ই মর্যাদাবান প্রতিপালক তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন।”
এরপর রাসুলুল্লাহ ﷺ অল্প সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন— এটি ওহির অবতরণের মুহূর্ত ছিল। জাগ্রত হয়ে তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন: “আবু বকর! তোমার জন্য সুসংবাদ! জিবরাঈল আগমন করেছেন, তাঁর ঘোড়ার সামনের পা থেকে ধূলিকণা উড়ছে।”
পরে তিনি তাবু থেকে বের হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হন এবং এই আয়াত তিলাওয়াত করতে করতে এগিয়ে যান:
”سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّونَ الدُّبُرَ“
অনুবাদ: শত্রুসংঘ দ্রুতই পরাজিত হবে এবং পিঠ দেখিয়ে পালাবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস ও প্রাণশক্তি নিয়ে সেনাবাহিনীর দিকে এগিয়ে গেলেন, এক মুঠো মাটি তুলে কাফিরদের দিকে নিক্ষেপ করে বললেন: “شاهت الوجوه”
“বিনাশ হোক এই মুখগুলো।”
এই মাটি প্রত্যেক কাফিরের চোখে ও নাসারন্ধ্রে গিয়ে পড়ে। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
”وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى“
অনুবাদ: (হে নবী!) যখন আপনি নিক্ষেপ করেছিলেন, তখন বাস্তবে আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন।
তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হন এবং সেনাবাহিনীকে প্রতিআক্রমণের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন: “شدوا”
“তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ো!”
এরপর তিনি মুজাহিদদের যুদ্ধের জন্য উদ্দীপ্ত করে বললেন:
”والذي نفس محمد بيده، لا يُقاتلهم اليوم رجل فقتل صابرا محتسبا مقبلا غير مدبر، إلا أدخله الله الجنة“
অনুবাদ: সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি ধৈর্য ও সওয়াবের নিয়তে, শত্রুর সম্মুখীন হয়ে, পশ্চাদপসরণ না করে যুদ্ধ করে শহীদ হবে, আল্লাহ অবশ্যই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
আল্লাহর রাহে লড়াইকারী সেনাদের মনোবল ছিল উঁচু; কিন্তু রাসুলুল্লাহ ﷺ–এর এ বক্তব্যে তাদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়। তারা শত্রুর পরাজিত ও বিভ্রান্ত বাহিনীর উপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
যখন তারা তাদের সেনাপতিকে বর্ম পরিহিত অবস্থায় সারির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল এবং তাঁর মুখে শুনল এই আয়াত:
”سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّونَ الدُّبُر“
তখন তাদের প্রাণোচ্ছ্বাস আরও তুঙ্গে পৌঁছায়।
বদরের যুদ্ধ একমাত্র গাযওয়া, যেখানে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের সহায়তায় ফেরেশতাদের পাঠিয়েছেন। ইবনে সা’দ, হযরত ইকরিমা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন:
“আমরা দেখতাম, কোনো মুশরিকের মাথা কেটে যাচ্ছে, বা তার হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কে আঘাত করেছে তা বুঝতে পারতাম না।”
প্রশ্ন হলো—ফেরেশতাদের এত বড় বহর কেন? তারা কেন নেমেছিলেন?ইনশাআল্লাহ, এ প্রশ্নগুলোর উত্তর “গাযওয়া বদর থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও উপদেশ” শিরোনামে বিশ্লেষণ করা হবে।
তবে ফেরেশতাদের আগমনের কথা কুরআন, হাদীস এবং বদরের সাহাবাগণের বর্ণনায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
আল্লাহ বলেন:
”إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلَائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ…“
অনুবাদ: স্মরণ করো সেই সময়, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি ওহি করলেন: “আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, অতএব তোমরা ঈমানদারদের দৃঢ় রাখো, আমি কাফিরদের অন্তরে ভয় জাগিয়ে দেব। অতএব তাদের গর্দানে ও প্রত্যেক আঙ্গুলের সন্ধিতে আঘাত হানো।”
আরও বলেন:
”إِذْ تَقُولُ لِلْمُؤْمِنِينَ…“
অনুবাদ: স্মরণ করো, যখন তুমি মুমিনদের বলছিলে: “তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক তিন হাজার ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন?”
আরও ইরশাদ:
”بَلَىٰ إِن تَصْبِرُوا…“
অনুবাদ: হ্যাঁ, যদি তোমরা ধৈর্য ধরো ও তাকওয়া অবলম্বন করো, এবং তারা এখনই তোমাদের উপর চড়াও হয়, তবে তোমাদের রব পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।
হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ঘটনা:
হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, বদরের যুদ্ধে এক আনসারী সাহাবি এক মুশরিককে ধাওয়া করছিলেন। তখন তিনি একটি ঘোড়ার হুঙ্কার শুনলেন এবং শুনলেন কেউ বলছে: “اقدِم حيزوم”
“অগ্রসর হও হিযূম!” (হিযূম ছিল ঘোড়াটির নাম)।
তিনি দেখলেন, সেই মুশরিক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তার নাক কাটা এবং মুখে চাবুকের মতো ক্ষত।
পরে সেই সাহাবি এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ কে ঘটনাটি বললে তিনি বললেন:
”صدقت، ذلک مدد من السماء الثالثة“
অনুবাদ: “তুমি সত্য বলেছো, এটি ছিল তৃতীয় আসমান থেকে আগত সাহায্য।”
এই হাদীস মুসলিম (রহ.) বর্ণনা করেছেন।