ফেরেশতাদের অবতরণের পেছনে হিকমত
কিছু চিন্তাশীল হৃদয় প্রশ্ন করতে পারে—আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কি এমন সর্বশক্তিমান নন, যিনি ক্ষুদ্রসংখ্যক ঈমানদারদেরকে বিশাল কাফির বাহিনীর উপর তাঁর কোনো বাহ্যিক সাহায্য ছাড়াই বিজয়ী করে তুলতে পারেন? তা হলে কেন তিনি ফেরেশতাদের প্রেরণ করলেন?
এর উত্তর এই যে—ফেরেশতাদের আবির্ভাব ছিল মূলত মুমিনদের হৃদয়ের প্রশান্তি ও চিত্তের স্থিরতার জন্য। প্রকৃত হিকমত এই যে, ঈমানদারগণ যেন সেই অপার্থিব দৃশ্য অবলোকন করে সাহস সঞ্চয় করেন। কারণ মানবপ্রকৃতি দৃষ্টমানের উপর নির্ভরশীল, বাহ্যিক দৃশ্য যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে চিত্তও দৃঢ় হয় এবং সে শত্রুর মুখোমুখি সাহসিকতার সঙ্গে অবতীর্ণ হয়। সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম যদিও ভয়গ্রস্ত ছিলেন না, তথাপি মানবিক প্রবৃত্তির দাবি তো থেকেই যায়। এ প্রজ্ঞা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতে ব্যাখ্যা করেছেন—
> {وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ} [আলে ইমরান: ১২৬]
অর্থ: আল্লাহ তা‘আলা এই (ফেরেশতাদের আগমন) কেবল তোমাদের জন্য এক সুসংবাদরূপে করেছেন এবং এজন্য যে, তোমাদের হৃদয় যেন তাতে শান্ত হয়। আর সাহায্য তো কেবলমাত্র আল্লাহরই পক্ষ হতে আসে, যিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
এই আয়াতটি মুমিন অন্তরের অন্তঃস্থলে এই বোধ জাগ্রত করে যে, তাকে উপায়-উপকরণের প্রতি উদাসীন না থেকে তা অর্জন করতে হবে, তা ব্যবহার করতেও হবে, শত্রুর মোকাবিলায় তা প্রয়োগ করাও আবশ্যক; তবে এইসব উপকরণই যেন তার আস্থা ও নির্ভরতার কেন্দ্র না হয়। কারণ বিজয়ের একমাত্র উৎস তো সেই মহান সত্তা, যিনি অদৃশ্য থেকে সাহায্য বর্ষণ করেন। যেমনটি ভ্রান্ত সে ব্যক্তি, যে সবরকম উপকরণ অস্বীকার করে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরতার নামে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে চলে, তেমনই গোমরাহ সে ব্যক্তি, যে বাহ্যিক উপকরণের মোহে আত্মশক্তির বিভ্রমে পতিত হয়ে আত্মিক সাহায্যের ধারণাই বিস্মৃত হয়।
আধুনিক কালের এক সুস্পষ্ট সংকট হলো—এই দুই চরম অবস্থানের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়া। একদল আত্মতুষ্টি ও তাওয়াক্কুলের ছদ্মবেশে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকে; আল্লাহর আদেশানুযায়ী শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুতির আয়াতগুলো তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। অন্যদিকে একদল এমন, যারা বাহ্যিক উপকরণের চর্চায় এতটাই ডুবে যায় যে, তারা আল্লাহর আসমানী সাহায্য ও রূহানিয়্যাতের অস্তিত্বই অস্বীকার করে বসে। অথচ সাফল্য তাদেরই প্রাপ্য, যারা এই দুইয়ের মাঝে এক সূক্ষ্ম, ভারসাম্যময় রেখায় অবিচল থাকে।
কিছু মানুষ এই আয়াত থেকে এই ধারণা গ্রহণ করে থাকেন—ফেরেশতাদের অবতরণ বলতে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তির বর্ষণ বোঝানো হয়েছে। তাদের ভাষ্যে, প্রকৃত ফেরেশতা আগমন করেননি, বরং মুমিনদের চিত্তে যে এক অনির্বচনীয় রূহানী শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল, তাকে প্রতীকী অর্থে ফেরেশতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই মতবাদ তত্ত্বগত ও গ্রন্থগত—উভয় দিক থেকেই প্রত্যাখ্যাত। কারণ, কুরআনে ফেরেশতাদের নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে—যা কোনো রূহানী শক্তির উপমা হতে পারে না। আবার, একাধিক সহীহ হাদীসে জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সরাসরি উপস্থিতির বিবরণও এ মতবাদ খণ্ডন করে। অতএব, ফেরেশতাদের অবতরণ ছিল বাস্তব, দৃষ্টিগোচর এবং বাহ্যিকভাবে প্রত্যক্ষযোগ্য।
এছাড়া ফেরেশতাদের প্রেরণের আরেকটি প্রজ্ঞা ছিল কাফিরদের অন্তরে ভয় ও আতঙ্ক সঞ্চার। তারা মুসলিমদের কাতারে এমন কিছু অপরিচিত, অচেনা মুখাবয়ব প্রত্যক্ষ করেছিল, যারা অতিপ্রাকৃত শক্তিতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। এই অভিজ্ঞতা তাদের মনে এমন এক ভীতি সৃষ্টি করেছিল—যা শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয়ের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
একটি চিন্তনমূলক তাত্ত্বিক দিক:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তিনটি আয়াতে ফেরেশতাদের অবতরণের উল্লেখ করেছেন। প্রথম দুটি আয়াত সূরা আলে ইমরানে, যার একটিতে তিন হাজার ফেরেশতা এবং অপরটিতে পাঁচ হাজার ফেরেশতার অবতরণের বর্ণনা রয়েছে। তৃতীয় আয়াতটি সূরা আনফালে, যেখানে বলা হয়েছে—এক হাজার ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
এই আয়াতগুলো একত্রে বিশ্লেষণ করে তাফসিরকারগণ মন্তব্য করেছেন—আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে এক হাজার ফেরেশতার মাধ্যমে সাহায্য করেন, তারপর সংখ্যাবৃদ্ধি করে তিন হাজারে উন্নীত করেন, এবং শেষে তা পাঁচ হাজারে পরিণত করেন। এই ব্যাখ্যার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় সূরা আনফালের নিম্নোক্ত আয়াতে:
{إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ}
অর্থ: যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তখন তিনি তা কবুল করে বলেছিলেন—আমি তোমাদের সহায়তায় এক হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করবো, যারা একের পর এক অবতীর্ণ হবে।
এখানে “মুরদিফীন” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ—ক্রমাগত, পর্যায়ক্রমে আগমনকারী। অর্থাৎ প্রথম এক হাজার, তারপর দ্বিতীয় সহস্র, এরপর তৃতীয় সহস্র… এভাবে ধারাবাহিকভাবে মোট পাঁচ হাজার ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়েছেন।