এক সাবেক দাঈশ সদস্যের মুখে দাঈশের গল্প!

[প্রথম পর্ব]

✍🏻 উসামা হুম্মাম

সাল ২০১৪। দাঈশ নামক এক সন্ত্রাসী সংগঠন তাদের সদস্যসংখ্যায় অভূতপূর্ব বৃদ্ধি লক্ষ্য করায় বিশ্বব্যাপী এক কাল্পনিক খিলাফতের দাবি উত্থাপন করে। তাদের জটিল এবং সুচিন্তিত প্রচারণা সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে এক মোহময় আকর্ষণ তৈরি করেছিল। উপরন্তু তাদের সংঘটিত প্রচারণা এতটাই কৌশলী ও মর্মস্পর্শী ছিল যে, এর আড়ালে তারা নিজেদের সকল ত্রুটি ও অপরাধ লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।

জার্মান বংশোদ্ভূত বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও সাংবাদিক জার্গেন টুডেনহোফার (Jürgen Tudenhofer) এই অঞ্চলের সশস্ত্র সংঘর্ষের অন্তর্গত গোষ্ঠীগুলোর ওপর গভীর পর্যবেক্ষণ চালিয়েছেন। বিশেষত দাঈশের কার্যকলাপ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তাদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেননি; বরং সেই সদস্যদের সঙ্গে সংলাপ স্থাপন করেন, যারা অভ্যন্তরীণ অরাজকতার প্রত্যক্ষদর্শী। তার এই সাক্ষাৎকারগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিতও হয়েছিল, যা সারাজীবন অভিজ্ঞানমূলক দলিল হয়ে থাকবে।

এরই ধারাবাহিকতায়, তিনি সিরিয়ার মাটিতে অবস্থানকারী এক জার্মান সদস্য সালিমের সঙ্গে আলাপচারিতা করেন। সালিম, যিনি দাঈশের অভ্যন্তরীণ ভণ্ডামি ও নিষ্ঠুরতার একজন জীবন্ত সাক্ষী।

সালিম তার পূর্ববর্তী পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে জাবহাতুন নুসরাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু দাঈশ যখন নিজেদের প্রচারণার সূক্ষ্ম জালে বিশ্বকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে, তখন সালিমও তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি। ২০১৪ সালে স্কাইপের মাধ্যমে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারের সময় দাঈশের তথাকথিত খলিফা আবুবকর আল-বাগদাদী এক বিভ্রান্তিকর খিলাফতের ঘোষণা দেয়।

সাক্ষাৎকারে সালিম দাঈশ সম্পর্কে বলেন:
“আল-বাগদাদি তার সকল শক্তি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সম্পদ, যেগুলোকে তারা গণীমত হিসেবে দাবি করে, তা মূলত তার ব্যক্তিগত ভাণ্ডারে যুক্ত হয়।

দাঈশ প্রকৃতপক্ষে জিহাদের প্রকৃত অর্থ এবং মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তারা সহনশীলতার পরিবর্তে নিষ্ঠুরতাকে অগ্রাধিকার দেয়। উদাহরণস্বরূপ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি দীর্ঘ চার দশক ধরে ধূমপানের নেশায় আসক্ত, তাকে শুধুমাত্র এই কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর তারা এমন কোনো দুষ্কর্ম আছে, যা করতে দ্বিধা করে? (এখানে সালিম তাদের নির্মম চরমপন্থার প্রতি ইঙ্গিত করেন)।”

তাঁর বেদনাহত হৃদয়ের গহন থেকে উঠে আসে আরেকটি অভিযোগ:
“দাঈশ একদল রক্তপিপাসু ঘাতক। তাদের দাবি তারা আল্লাহর আইন অনুসারে পরিচালিত হয়। কিন্তু এই প্রশ্ন তো তোলাই যায়, তারা যে মানুষদের হত্যা করে, সেই রায় কোন আদালতের মাধ্যমে আসে? তারা চরম তাড়াহুড়ো এবং অমানবিকতার আশ্রয় নেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি ধূমপান করছে দেখে তাকে ধরে সঙ্গে সঙ্গে তার হাত কেটে ফেলে।”

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সালিম বলেন:
“আমার চোখের সামনে সিগারেটের কয়েক ডজন প্যাকেট পড়ে ছিল। সেখানকার কিছু সদস্য আছে যারা দাড়ি রাখে না, মিউজিক শোনে এবং তাদের ইচ্ছানুযায়ী যা খুশি করে।”

এটি আমাদের স্পষ্ট করে যে, দাঈশের খাওয়ারিজরা তাদের নিজেদের জন্য নির্ধারিত একরকম দ্বিচারিতাপূর্ণ শাসননীতি প্রণয়ন করে। তারা অন্যদের প্রতি নির্মম অথচ নিজেদের ক্ষেত্রে শৈথিল্যের এক নিদর্শন। তাদের স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয় অসংখ্য নিরপরাধ প্রাণ, যারা মরুভূমির তথাকথিত আদালতের নামে একের পর এক মৃত্যুবরণ করে।

আফগানিস্তানে এই গোষ্ঠীর অভ্যুদয়ের পর, তারা নাঙ্গারহারের মামুন্দ ও বাটিকোট অঞ্চলে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। সেই সকল হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জীবিত সদস্যরা আজও তাদের নির্মমতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছেন। দাইশের জন্য, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এক ধরনের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়েছে।

Exit mobile version