✍🏻 উসামা হুম্মাম
তৃতীয় পর্বে আমরা আবু ক্বাতাদাহ নামক এক জার্মান আইএসআইএস সদস্যের জীবনপ্রবাহ তুলে ধরেছিলাম এবং তার জবানিতে আইএসআইএসের কার্যক্রম সংক্রান্ত কিছু বক্তব্য নিবদ্ধ করেছিলাম। খ্যাতনামা সাংবাদিক ও লেখক জার্গেন টোডেনহোফার (Jürgen Todenhöfer) আবু ক্বাতাদাহর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে সিরিয়ার মাটিতে পা রেখে আইএসআইএস এবং তাদের ভয়ঙ্কর কার্যকলাপ সরাসরি প্রত্যক্ষ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
আইএসআইএসের এক উচ্চপদস্থ নেতার কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুমোদনপত্রের ভিত্তিতে টোডেনহোফার তুরস্ক থেকে তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অনায়াসে প্রবেশাধিকার পান। সেখানকার পরিস্থিতি অবলোকন করার লক্ষ্যে তিনি আবু ক্বাতাদাহ ও তার সহচরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নির্ধারিত দশ দিনের এক সাহসী অভিযানে তিনি বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং কোনো সেন্সরশিপের শিকার না হয়ে নিজের প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন।
যদিও এই সফর চলাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। আইএসআইএস সদস্যদের পক্ষ থেকে তাকে একাধিকবার হুমকি প্রদান করা হয়, এমনকি প্রাণনাশের শঙ্কাও তার পিছু ছাড়েনি। তার চলাফেরায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল, এবং তাকে কখনোই একা চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার প্রতিটি পদক্ষেপে সশস্ত্র প্রহরী উপস্থিত থাকত। সফরকালীন তার তোলা প্রতিটি ছবি এবং সাক্ষাৎকার পরবর্তীতে আইএসআইএসের পক্ষ থেকে কঠোর পর্যালোচনার মুখোমুখি হয়। ফলে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি ও একটি সাক্ষাৎকার মুছে ফেলা হয়, কারণ সেগুলো সংগঠনের ভয়ঙ্কর রূপ উন্মোচন করত।
আবু ক্বাতাদাহ তাকফিরি মতবাদের বশবর্তী হয়ে তালেবান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করত। সে দাবি করত, মোল্লা মুহাম্মাদ উমর মুজাহিদের আদর্শ ও দর্শন ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী। এমন বক্তব্যের মূল কারণ হলো, আইএসআইএস নিজেদের লড়াইকেই “জিহাদ” এবং নিজেদের আন্দোলনকেই “ইসলামী” বলে আখ্যায়িত করে। অন্য কোনো বৈধ জিহাদি আন্দোলনকে তারা কখনোই সহ্য করতে পারে না। তাদের এই চরম দৃষ্টিভঙ্গি এমন এক সীমায় পৌঁছেছে, যেখানে তারা নিজেদের বাহিরে প্রতিটি আদর্শ ও আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে।
এই চরমপন্থী দল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত মুসলিমদের ‘কাফির’ আখ্যা দিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। দলত্যাগীদের ‘মুরতাদ’ বলে চিহ্নিত করে তাদের ওপর নির্মম শাস্তি আরোপ করে। আবু ক্বাতাদাহর বিশ্বাস ছিল, যারা এই সংগঠন ত্যাগ করেছে, তারা সবাই মুরতাদ। যদি তারা তওবা না করে, তবে তাদের হত্যা করা হবে।
আইএসআইএস তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক যোদ্ধাদের কৌশলগত কাজে ব্যবহার করে, যারা এখনো ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষমতা অর্জন করেনি। টোডেনহোফার তার সফরের চতুর্থ দিনে আবু ক্বাতাদাহ ও তার সহযোগীদের সঙ্গে মসুল শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে আবু লুত নামক এক আইএসআইএস সাংবাদিক তাদের সামরিক কার্যক্রম ও যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেয়।
আবু লুত জানায়, আইএসআইএসের একজন জার্মান যোদ্ধা, যার বয়স ছিল মাত্র ষোলো বছর, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়। এই ঘটনা ছিল আইএসআইএসে অপ্রাপ্তবয়স্ক যোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির এক করুণ উদাহরণ। সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের এমন যোদ্ধার সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য।
আবু লুত আরও জানায় যে, বোরিক নামে এক জার্মান যোদ্ধা, যিনি একসময় জার্মান জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন, এবং আমেরিকার টেক্সাসের এক যোদ্ধা, যার পিতা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন, তারাও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমনকি কিছু আরব-ইসরায়েলি, যারা ইসরায়েলি পাসপোর্টধারী, তারাও আইএসআইএসের হয়ে লড়াই করত।
মসুল দখল প্রসঙ্গে আবু লুত বলে যে, এটি ছিল দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। মসুলে তারা এত সংখ্যক আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করেছিল যে, শহরবাসী নিরাপত্তাবোধ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। এমনকি আইএসআইএস তাদের নিজস্ব সদস্যদের পবিত্র কুরআন খতমের অনুষ্ঠানে আত্মঘাতী হামলা পরিচালনার জন্য পাঠাতো। এভাবে মসুলের শান্তি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
টোডেনহোফারের দশ দিনের এই অভিজ্ঞতা, যা শুরু হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে, এক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। বইটিতে আইএসআইএসের চরমপন্থা, তাদের কার্যক্রম এবং মানবতার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান অত্যন্ত গভীরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা এই গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তুকে চারটি পর্বে সংক্ষেপিত করেছি।
আসল সত্য হলো, আইএসআইএসের কার্যকলাপ এতটাই বিভীষিকাময় যে, এই বিষয়ে শত শত গ্রন্থ রচনা করলেও কম হবে। আইএসআইএসের বর্বরতা ও চরমপন্থা বারবার মানবতার বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এটি কেবল তাদের নৃশংসতার একটি চিত্র নয়, বরং এটি একটি অমূল্য শিক্ষা— চরমপন্থা ও বিভ্রান্তিকর আদর্শের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা মানবজাতির জন্য কতটা অপরিহার্য।