চলতি বছর মার্কিন দখল থেকে আফগানিস্তানের মুক্তির চতুর্থ বর্ষপূর্তি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন দেশে পুনর্গঠন ও জনকল্যাণে অসংখ্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। জাতীয় মহাসড়ক ও শহরাঞ্চলে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্পষ্ট আলামত দৃশ্যমান। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক যোগাযোগেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো—রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইসলামি ইমারাতকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান।
আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবস (১৫ আগস্ট) সমসাময়িক ইতিহাসে এক মহিমান্বিত ও দীপ্তিময় ঘটনা, যার পেছনে রয়েছে হাজারো শহীদের আত্মদান ও মুজাহিদদের দীর্ঘ সংগ্রাম। এর পাশাপাশি ইসলামি ইমারাতের দৃঢ় পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশল, যার কেন্দ্র ছিল কাতারের রাজনৈতিক দপ্তর ও দোহা চুক্তি যা কখনো ভোলার নয়। ইসলামি ইমারাতের প্রতিনিধিদলের কার্যকর কূটনীতি ও শরিয়াভিত্তিক সুস্পষ্ট অবস্থান এমন বাস্তবতা তৈরি করে, যাতে দখলদার বাহিনীর অবসান ঘটে, প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী আফগানিস্তানের যুদ্ধ থেমে যায়, এবং প্রতিষ্ঠিত হয় প্রকৃত শান্তি—যার সুবাদে আজ আফগান জনগণ শান্তি ও স্বস্তির জীবন যাপন করছে।
একটি শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি দাঁড়িয়ে থাকে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, জাতীয় ঐক্য, জনসমর্থন, সিদ্ধান্তগ্রহণের সক্ষমতা ও ক্ষমতার বৈধতার ওপর—এবং আজ আফগানিস্তান এসব নে‘আমতের অধিকারী। ২০২৫ সাল, যা ইসলামি ইমারাতের শাসনের চতুর্থ বছর, তাতে সক্রিয় ও কার্যকর কূটনীতির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বৈশ্বিক স্বীকৃতি না থাকা সত্ত্বেও আফগানিস্তান প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের নিকট উচ্চ মর্যাদা বজায় রেখেছে এবং বহু কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় কূটনীতি আজ এমন এক ভাষা, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ তাদের জাতীয় স্বার্থ ও জনকল্যাণের প্রয়োজনসমূহ বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দেয়। ইসলামি ইমারাত একই নীতি মেনে অবিচল ও নীতিনিষ্ঠ অবস্থান নিয়ে বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে আফগানিস্তানে আর কোনো চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ নেই; বর্তমান শান্ত আফগানিস্তান বিশ্বের সাথে সর্বপ্রকার শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক ও আলোচনায় প্রস্তুত। তবে নিজের সীমারেখা ও লক্ষ্যমাত্রা কোনো রাষ্ট্রের স্বার্থ বা অযৌক্তিক দাবির কাছে বিসর্জন দেওয়া সম্ভব নয়, এবং এ কারণেই তারা বিশ্ববাসীর আস্থা ও মর্যাদা অর্জন করেছে। আজ বহু দেশ ও এমনকি জাতিসংঘও এ বাস্তবতাকে স্বীকার করেছে; যারা একসময় অস্বীকারে অনড় ছিল, তারাও অবশেষে মাথা নত করতে বাধ্য হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব
ইসলামি ইমারাত ক্ষমতা পুনর্দখলের শুরু থেকেই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জাতীয় স্বার্থরক্ষার আলোকে প্রত্যেক প্রকার রাজনৈতিক সম্পর্কের জন্য প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছে। কাতারে তাদের রাজনৈতিক দপ্তর সব পক্ষের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এর ফলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী আজ ইসলামি ইমারাতের বিশ্বের ৪০টি দেশে সক্রিয় কূটনৈতিক মিশন রয়েছে, যার মধ্যে ইউরোপীয় রাষ্ট্রও অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ এশিয়ার বৃহৎ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিগুলোও রয়েছে, যারা ইসলামি ইমারাতের নিরপেক্ষ ও জাতীয় অবস্থান অনুধাবন করে একে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
অনেক দেশ এ বাস্তবতা উপলব্ধি করার পর স্বেচ্ছায় তাদের আফগান দূতাবাসসমূহ ইসলামি ইমারাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে হস্তান্তর করেছে। এসব দূতাবাসে আফগান কূটনীতিকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন এবং স্বাগতিক দেশে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হচ্ছেন, যা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও সঠিক পদক্ষেপ এবং ইসলামি ইমারাতবিরোধী প্রপাগান্ডাকারীদের জন্য কার্যকর জবাব।
কাবুলে সক্রিয় দূতাবাস
বিদেশি আফগান দূতাবাস ও কাতারের দপ্তরের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় বিশটিরও অধিক রাষ্ট্র যাদের মধ্যে কয়েকটি অতীতে আফগানিস্তানে কোনো প্রতিনিধিত্বই করেনি—আফগান জনগণের সাথে উন্নত ও কূটনৈতিক সম্পর্কের লক্ষ্যে কাবুলে পুনরায় দূতাবাস খোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতরা, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকা সত্ত্বেও, সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে, যা গত বছরের সংবাদ ও সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট প্রতিফলিত।
পড়শি দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য
অতীতে আফগানিস্তান প্রায়শই প্রতিবেশীদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ত, যার কারণ ছিল সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অভাব ও বাইরের হস্তক্ষেপ। কারো সাথে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা ও অন্যের সাথে দূরত্ব কূটনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করত; এর প্রভাব বাণিজ্য ও অভিবাসী আফগানদের জীবনযাত্রাতেও পড়ত। কোনো কোনো সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো শরণার্থীদের চাপ প্রয়োগের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। ইসলামি ইমারাত অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তিতে এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করেছে; ইরান ও পাকিস্তানের সাথে সীমান্তসংঘর্ষ সত্ত্বেও কূটনীতি সক্রিয় রেখেছে এবং সম্পর্কের স্থিতি নিশ্চিত করেছে।
আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিমিত প্রতিক্রিয়া
গত বছরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকার পূর্বের ন্যায় আফগানিস্তান ও ইসলামি ইমারাতের সমালোচনা করেছে, ভ্রান্ত ও পক্ষপাতদুষ্ট বিবৃতি দিয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি ইমারাতকে আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়ার পথে ঠেলে দেওয়া। কিন্তু ইসলামি ইমারাত কখনো নীরবতা পালন করেনি; বরং প্রতিটি পরিস্থিতিতে যথাসময়ে যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে; হোক তা হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের অন্যায্য রায়, গাযযায় ইসরাইলি বর্বরতা, অথবা আফগান অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ—ফলে বিরোধীদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে।
বৈদেশিক সফর ও অভ্যর্থনা
সম্প্রতি ইসলামি ইমারাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ওমান সফর করেছেন, যা জ্বালানি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনাময় দেশ। এর আগে মন্ত্রিসভার সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছেন, যেখানে তারা সেন্সর ছাড়াই নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। বিপরীতে, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধি দলও কাবুল সফর করেছে, আলোচনার মাধ্যমে আস্থা বৃদ্ধি করেছে এবং নিজ নিজ দেশে ইতিবাচক বার্তা নিয়ে ফিরেছে।
ইউনামা ও ম্যান্ডেট বৃদ্ধি
জাতিসংঘের আফগানিস্তান মিশন “ইউনামা” প্রতি বছরের শেষ দিকে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্বতন সরকারের আমলে এ বিষয়ে শুধু অনুরোধ ও আবেদন করা হতো; নেতিবাচক প্রতিবেদনগুলোকেও চুপচাপ মেনে নেওয়া হতো। কিন্তু এ বছর, যখন ইউনামা কার্যক্রম বন্ধের শর্ত দেয়, ইসলামি ইমারাত বিন্দুমাত্র নির্ভরতা প্রকাশ না করে বরং প্রশ্ন তোলে—কেন তাদের সাফল্যগুলো প্রতিবেদনগুলোতে তুলে ধরা হয় না? অবশেষে ইউনামা স্বয়ং তাদের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়েছে।
প্রচারণার জবাব
গত বছর কিছু রাষ্ট্র ও বিরোধী গোষ্ঠী বিদেশে রাজনৈতিক শরণার্থী ও ক্যাম্পবাসীদের একত্রিত করে সেমিনার ও ফোরামের মাধ্যমে আফগানিস্তানের বিকৃত চিত্র উপস্থাপন করেছে। এ প্রপাগান্ডার যথাসময়ে জবাব দিয়েছে ইসলামি ইমারাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রেস রিলিজ ও সম্মেলনের মাধ্যমে বাস্তবতা তুলে ধরে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছে।
দাঈশ খাওয়ারিজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
দাঈশ আজ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সমস্যা, যা সীমান্ত না মেনে বহু রাষ্ট্রে হত্যাযজ্ঞ চালায়। দুঃখজনক যে এদের বিরুদ্ধে ইসলামি ইমারাতের দৃঢ় পদক্ষেপ বিশ্ববাসীর কাছে যথাযথ স্বীকৃতি পায়নি। আফগানিস্তানে নিহত অধিকাংশ দাঈশ সদস্যের তথ্য প্রমাণ করে, তাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাঠানো হয়েছিল। একমাত্র ইসলামি ইমারাতই সাহসিকতার সাথে পদক্ষেপ নিয়ে আফগানিস্তান তথা বিশ্বকে এদের বিপদ থেকে অনেকাংশে রক্ষা করেছে।
উপসংহার
ইসলামি ইমারাতের পররাষ্ট্রনীতি এমন এক উত্তম নীতি, যাতে দেশের মূল্যবোধ, জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনীতি সর্বতোভাবে রক্ষিত হয়েছে। যে রাষ্ট্রগুলো পশ্চিম ও মার্কিন প্রভাবমুক্ত, তারা অনুধাবন করেছে ইসলামি ইমারাত একটি স্বাধীন ও স্বনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি ধারণ করে, এবং এর সাথে সম্পর্ক স্থাপনই ভবিষ্যতে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রস্তাবনা।