যখন মুসলিম বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করল, তখন সাঈদ ইবনু মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেন— আমরা আপনার জন্য একটি নিরাপদ ঘর তৈরি করে দিই, যেন আপনি সেখান থেকে যুদ্ধের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পারেন এবং কোনো জরুরি অবস্থায় সঠিক কৌশল অবলম্বনে সক্ষম হন। যদি আমরা জয়লাভ করি, তাহলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল; আর যদি পরাজিত হই, তাহলে আপনার জন্য একটি বাহন প্রস্তুত থাকবে যাতে আপনি নিরাপদে পেছনে অবস্থানরত মুসলিমদের কাছে পৌঁছাতে পারেন। কেননা আমাদের পেছনে এমন মানুষ রয়েছেন, যারা আমাদের থেকেও আপনাকে বেশি ভালোবাসে। যদি তারা জানতে পারত যে যুদ্ধ হবে, তাহলে তারা আপনাকে একা ফেলে রাখত না, অবশ্যই তারা আপনার সঙ্গে শরিক হতো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাঈদ ইবনু মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই প্রস্তাবনাকে সম্মান জানালেন ও তার জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি উঁচু স্থানে এই কৌশলগত কেন্দ্র নির্মিত হলো এবং আনসারদের একটি দলকে, সাঈদ ইবনু মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে, ওই কেন্দ্রের রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হলো।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, সেই রাতে মুসলিম বাহিনীর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল; কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র রাত আল্লাহর দরবারে দোয়ায় নিমগ্ন ছিলেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁদছিলেন, হাত তুলে আল্লাহর সাহায্য কামনা করছিলেন। (রেওয়ায়েত: তাবরানী)
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হযরত উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই রাতেই বদরের প্রান্তরে আসেন এবং আমাদেরকে কুরাইশদের নেতারা কোথায় নিহত হবে তা দেখিয়ে দেন। বর্ণনাকারী বলেন— আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে স্থানগুলো নির্দেশ করেছিলেন, সেগুলোর প্রত্যেকটিতেই শত্রুরা নিহত হয়েছিল, কেউ জীবিত রক্ষা পায়নি। (রেওয়ায়েত: মুসলিম)
রমযান মাসের সতেরো তারিখে ফজরের আলো উদিত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন—
“আস্-সালাতু ইবাদাল্লাহ!”
(হে আল্লাহর বান্দারা! নামাযের সময় হয়েছে)
এরপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গাছের নিচে দাঁড়ালেন এবং সমগ্র বাহিনীর ইমাম হিসেবে ফজরের নামায আদায় করালেন।
নামায শেষে মক্কার বাহিনী বদরের ময়দানের দিকে অগ্রসর হলো, তখন মুসলিম বাহিনীও সামনে এগিয়ে এল। উভয় বাহিনী একে অপরের সম্মুখে অবস্থান করল। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফিরদের বাহিনীর বিপুল সংখ্যা ও তাদের শক্তি প্রত্যক্ষ করলেন, তখন তিনি এ দোয়া করলেন:
اللهم هذه قریش قد أقبلت بخیلائها و فخرها تحادک، و تکذب رسولک، اللهم فنصرک الذي وعدتني، اللهم احنهم الغداة
(অনুবাদ):
হে আল্লাহ! এই কুরাইশ দম্ভ ও অহংকার নিয়ে এসেছে, তারা আপনার সঙ্গে শত্রুতা করে এবং আপনার রাসূলকে হেয় প্রতিপন্ন করে। হে আল্লাহ! আপনি সেই সাহায্য দিন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি আমাকে দিয়েছেন। হে আল্লাহ! আজই তাদের পরাভূত করুন এবং তাদের পিঠ ভেঙে দিন।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহিনীকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজালেন, ঠিক যেভাবে নামাযের জন্য কাতার তৈরি করা হয়। সম্মুখে ছিল ঢাল ও বর্শাধারীদের সারি, যাতে শত্রু অশ্বারোহীদের হামলা প্রতিহত করা যায়। এরপর তীরন্দাজ ও তলোয়ারধারীদের কাতার স্থাপন করা হয়।
ময়দানে তিনটি পতাকা ছিল— একটি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে, দ্বিতীয়টি হযরত মুসআব ইবনু উমায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে, আর তৃতীয়টি এক আনসারী সাহাবীর হাতে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিলেন:
”إذا دنا القوم فانضحوهم بالنبل“
(যখন শত্রু কাছে আসবে, তখন তাদের দিকে তীর বর্ষণ করো)।
এরপর বললেন:
”ولا تسلوا السیوف حتی یغشیکم“
(তলোয়ার বের কোরো না, যতক্ষণ না শত্রু তোমাদের কাতারে ঢুকে পড়ে)।
পুনরায় বললেন:
”واستبقوا نبلکم“
(তোমাদের তীর সংরক্ষণ করো), অর্থাৎ তীর নিক্ষেপে মিতব্যয়ী হও, যেন তীর শেষ না হয়ে যায়।
এইসব নির্দেশনা ও কৌশলসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়, এগুলো কোনো সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত ছিল না। প্রতিটি নির্দেশের পেছনে অসংখ্য হিকমত নিহিত ছিল। এই মহান নেতৃত্বের কারণেই মুসলিম বাহিনী সংখ্যায় কম হলেও অস্ত্রে সুসজ্জিত এক প্রবল শত্রুকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই কৌশল ও দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমেই আল্লাহর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাস্তব রূপ পেয়েছিল।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো— রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করেন, তখন তিনি পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অতঃপর তিনি হুকুম দিলেন, মুসলিম বাহিনী পশ্চিমমুখী হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক, যাতে সূর্যের আলো চোখে না লাগে এবং মনোসংযোগে ব্যাঘাত না ঘটে। ফলে কাফিরদের বাহিনী সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়, যা তাদের জন্য বিরূপ প্রমাণিত হয়।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীর সামনে ভাষণ দিলেন এবং জিহাদের ফজিলত বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন,
”قوموا إلی جنة عرضها السموات والارض“
(চলো সেই জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর সমান)।
এ কথা শুনে হযরত উমায়ের ইবনু হুমাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন:
“বাহ! বাহ!”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এমন কেন বললে?
তিনি বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমি আশা করি, আমি সেই জান্নাতে প্রবেশকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তুমি তারই যোগ্য।
এ কথা শোনার পর তিনি তাঁর থলে থেকে তিনটি খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। অতঃপর নিজেই নিজেকে বললেন, যদি এই খেজুরগুলো খেয়ে তারপর যুদ্ধে যাই, তবে তা দীর্ঘ জীবনের কারণ হয়ে যাবে!
এই কথা বলে তিনি খেজুরগুলো ছুড়ে দিলেন, এবং সাহসিকতার সঙ্গে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, শেষপর্যন্ত তিনি শাহাদাত বরণ করলেন।
যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাতার সোজা করছিলেন, তখন তাঁর হাতে একটি তীর ছিল। তিনি সেই তীর দিয়ে কাতার সোজা করছিলেন। তখন হযরত সাওয়াদ ইবনু গাযিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু কাতার থেকে সামান্য বেরিয়ে গিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমলভাবে তাঁর পেট ছুঁয়ে তীর দিয়ে ইঙ্গিত দিলেন যেন কাতারে ফিরে আসেন।
তখন সাওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে আঘাত দিয়েছেন, আমি এর বদলা নিতে চাই!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে নিজের চাদর সরিয়ে নিজের পবিত্র উদর উন্মুক্ত করে বললেন, এই নাও, বদলা নিয়ে নাও!
সাওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সামনে এগিয়ে এলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁর পবিত্র উদরে চুম্বন দিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সাওয়াদ! তুমি এমন কেন করলে?
তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি দেখছেন, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি, জীবন থাকবে কিনা জানি না। আমি চেয়েছি, আমার দেহ যেন আপনার পবিত্র দেহের সংস্পর্শে আসে।
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য কল্যাণের দোয়া করলেন।