ইসলামের ইতিহাসে খাওয়ারিজদের পরিচিতি চরমপন্থা ও বিভেদ সৃষ্টিকারী দল হিসেবে। উমাইয়াহ শাসকদের প্রতি তাদের তীব্র বিদ্বেষ এবং বৈরিতার রেশ মুয়াবিয়া ইবন আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামল থেকে শুরু করে উমাইয়াহ খেলাফতের পতন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুসলিম সমাজে তারা বারবার অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে এবং ইসলামের শাশ্বত ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছে।
আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের খেলাফতের সময়, খাওয়ারিজদের প্রভাব আরব উপদ্বীপ, ইয়েমেন, ইরাক এবং শামের (গ্রেটার সিরিয়া) বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের উগ্র মতাদর্শের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়েছিল। খাওয়ারিজরা নিজেদের আকীদার প্রচারক হিসেবে পরিচিত করলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা উমাইয়াহ খেলাফতের বৈধতাকে অস্বীকার করে এবং শাসনব্যবস্থার ভিত দুর্বল করতে চেয়েছিল।
মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তেকালের পর খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর পুত্র ইয়াজিদ ইবন মুয়াবিয়া। কিন্তু এই উত্তরাধিকারের বিষয়টি সাধারণ জনগণ এবং অনেক সাহাবীর নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিশিষ্ট সাহাবীদের একটি বড় অংশ ইয়াজিদের আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করেন, যার মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়াজিদের খেলাফত অস্বীকার করে একটি স্বাধীন খেলাফতের ঘোষণা দেন। তাঁর এই অবস্থান ইয়াজিদের শাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়। ঠিক সেই সময়ে খাওয়ারিজদের কিছু নেতা তাঁর কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে আসে। তারা জানায়, যদি তিনি তাদের মতবাদ গ্রহণ করেন, তবে উমাইয়াহ শাসনের বিরুদ্ধে তারা তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতা দেবে।
খাওয়ারিজদের এই প্রস্তাব কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালিত ছিল। অতীতের ঘটনা প্রবাহ থেকে খাওয়ারিজদের প্রকৃত অভিপ্রায় স্পষ্ট বোঝা যায়। তারা উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করত। বিশেষত তারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি অত্যন্ত শত্রুতা পোষণ করত কারণ নাহরাওয়ানের যুদ্ধে বিদ্রোহের দায়ে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রায় ৪,০০০ খারিজী বিদ্রোহীকে দমন করেছিলেন। এই বিদ্রোহীরা তখন শ্লোগান দিয়েছিল, “আল্লাহ ছাড়া আর কারও ফায়সালা করার অধিকার নেই”, যা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের আপত্তি প্রকাশ করে।
আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে আসা খাওয়ারিজরা ছিল সেই বিদ্রোহী দলের অবশিষ্টাংশ, যারা একসময় পরাজয়ের পর আশপাশের এলাকায় আত্মগোপন করেছিল। এবার তারা আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ব্যবহার করে মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
তবে খারিজীদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। যখন তারা সাহাবায়ে কেরামের রাদিয়াল্লাহু আনহুম সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতামত জানতে চায়, তখন তিনি তাদের সামনে একটি সুদীর্ঘ বক্তৃতা দেন। এতে তিনি উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু, এবং যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুএর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেন এবং খাওয়ারিজদের মতবাদকে কঠোর ভাষায় খণ্ডন করেন।
আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই অটল অবস্থানের কারণে খাওয়ারিজরা হতাশ হয়ে ফিরে যায় এবং তাঁকে শত্রু ঘোষণা করে। তবে তাদের বিদ্রোহ থেমে থাকেনি। তারা বিভিন্ন অঞ্চলে আবার অরাজকতা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে মুসআব ইবনু যুবাইর আল মুহাল্লাব, এবং আল হাজ্জাজের মতো দক্ষ সেনাপতিদের নেতৃত্বে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হয়।
এই কঠোর পদক্ষেপ উমাইয়াহ খেলাফতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং আবদুল মালিক ইবনু মারওয়ানের শাসনকে খাওয়ারিজদের ফিতনা ও চক্রান্ত থেকে রক্ষা করে।