দাঈশ: বিস্তার থেকে বিলুপ্তির প্রান্তসীমা

✍🏻 জুনাইদ যাহিদ

বাস্তবপ্রতীতি এই যে, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিন্যাস, ক্রমপরিবর্তিত ভূমিকা এবং এক নবদিগন্তাভিমুখে অভিযাত্রমাণ পৃথিবী—এই সমগ্র অনুঘটক-সমাহার সে সব আন্দোলনকে, যেগুলি একদা পরাধীন শাসকের অধীন দাসস্বরূপ নিষ্ঠায় কর্মনিবিষ্ট থাকত, আজ তাদের সত্তা-সংরক্ষণে দিবানিশি উদ্দীপ্ত করে তুলেছে।

দাঈশ—যে সংগঠন কালের অদূরে স্বীয় ভূসীমা সম্প্রসারণের বাসনা পোষণ করত, আজ এতটাই নিরুপায় ও বৈশ্বিক কৌশলপ্রতীতি থেকে বিচ্যুত যে, তাদের চৈতন্যে অবশিষ্ট একমাত্র আকুলতা—অস্তিত্ব রক্ষা। ঔপনিবেশিক পরাশক্তিগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিও দাঈশ সম্পর্কে আমূল রূপান্তরিত; প্রারম্ভ থেকেই যার কোলে কার্যকর বার্তা ছিল না, বিশ্বমঞ্চে তার জন্য আর কোনো আসন অবশিষ্ট নেই।

স্বভাবতই, সামরিক-বৌদ্ধিক-রাজনৈতিক প্রাধান্যে উদগ্রীব শক্তিসমূহ এমন সঙ্ঘের পৃষ্ঠপোষকতায় আর আগ্রহী নয়। দাঈশ এখন বিস্তার-স্বপ্ন ত্যাগ করে বিদ্যমান ভগ্নাবশেষ আঁকড়ে রাখাতেই উন্মুখ—যত দূর সম্ভব, বিলুপ্তি এড়ানোই তার একমাত্র ব্রত।

যে দাঈশ কয়েক বর্ষ আগে জগতের উপর আধিপত্যের দুঃস্বপ্ন বুনেছিল, আজ সে এত নিঃসঙ্গ যে তার রাজনৈতিক ও সামরিক মজবুতি উভয়ই লোপ পেয়েছে; অবশিষ্ট কেবল নিজ সত্তাকে টিকিয়ে রাখার অন্তহীন লড়াই।

সে-ই দাঈশ—যারা পৃথিবীকে ত্রয়ী ভূগোলিক বৃত্তে বিভক্ত করেছিল: অভ্যন্তরীণ বৃত্ত—ইরাক ও শাম; নিকটবর্তী পরিধি—বিস্তৃত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা; ও দূরবর্তী পরিসর—ইউরোপ, পূর্ব-এশিয়া ও আমেরিকা—এবং যে-সমস্ত পরিসরে শাসনের অনাহূত স্বপ্ন দেখেছিল, আজ এতটাই অসহায় যে নিজ দেহ ঢাকার স্থিতধী আশ্রয়ও তার কপালে জোটে না।

তার বিদ্যমান কৌশল এমনই দুর্বল যে বেঁচে থাকা ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্য নেই। ধরা যাক, তারা কোনোমতে সফলও হলো—তবু সেরা সম্ভাবনা এটুকুই যে আবার এক যুদ্ধাঘাতী আন্দোলন হিসেবে তার নাম উচ্চারিত হবে। সন্ত্রাস-ভয়-উৎপাদক সঙ্ঘ-ইতিহাসে এক ঝলক দৃষ্টিপাতই প্রমাণ করে—গোপন এজেন্ডা ও দাসত্ব-ভিত্তিতে উদ্ভূত আন্দোলনের পরিণতি কতো করুণ।

দাঈশের আকস্মিক প্রভাব যেমন বিশ্বকে বিষ্ময়ে স্তম্ভিত করেছিল, তেমনি অল্পকালেই তার শিকড়, কাঠামো ও প্রকৃতি উন্মোচিত হয়। তার ধ্বংসাত্মক মানসিকতা এত নীচ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও মানবিক-মর্যাদাবর্জিত যে জাতিগণ কেবল মতাদর্শ হতে নয়—স্বয়ং এই সঙ্ঘ থেকেও ঘৃণা-ঘোষে মুখর হয়।

এখন পরাজিত এই দলটি টিকে থাকার জন্য যেকোনো মূল্য চুকাতে প্রস্তুত—প্রয়োজনে তারা মানবিক মর্যাদা ও নীতিবোধকেও বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। তাদের মতাদর্শ সুবিবেচনা ও নীতিপরায়ণ বুদ্ধিবৃত্তি থেকে শুন্য, জীবন্ত ধর্ম-চিন্তার সাথেও অসংশ্লিষ্ট; ফলে সামরিক পতিক্রমের সঙ্গে-সঙ্গে সামজিক-গণভিত্তিও বিসর্জিত। দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট—জনসমর্থন বিচ্ছিন্ন হলে ঔপনিবেশিক পরাশক্তির চোখে সে মূল্যহীন দাবার ঘুঁটিতে পর্যবসিত হয়।

দাঈশের অর্থায়ন পাশ্চাত্য দিয়েছিল ততক্ষণই, যতক্ষণ সে ব্যবহারযোগ্য ছিল। বাস্তব স্বরূপ বিশ্বসমাজ ও আঞ্চলিক জনতার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হতেই তার কার্যকারিতা লোপ পায়। এখন তাদের সংগ্রাম কেবল অস্তিত্ব রক্ষা—কোনো নাম বা উপাধিতে পরিচিত হবে কি-না তা গৌণ; উদ্দেশ্য মাত্র এক—জীবিত থাকা।

আজ তাদের জন্য কোনো সীমানা, লালরেখা, রণকৌশল বা অভীষ্ট অবশিষ্ট নেই। যেন এক নব্য প্লাবনের মাঝে আটকে পড়া মানব, প্রাণরক্ষায় যত্রতত্র কাঁটা-তৃণ আঁকড়ে ধরছে—শুধু যাতে ডুবতে না হয়, নিঃশেষ হতে না হয়।

Exit mobile version