এ ভূমি শাহাদাতের… এ ভূমি আত্মত্যাগের

✍🏻 নু’মান সাঈদ

ইসলামী ইমারাত আফগানিস্তানের ইন্টেলিজেন্সের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল, আলহাজ্জ তাজ মীর জওয়াদ হাফিযাহুল্লাহর নতুন আলোচনা শুনলাম। এই খুতবা তিনি গতকাল পাকতিয়া প্রদেশের সাঈদ করম জেলায় শহীদদের স্মরণে আয়োজিত এক মহিমান্বিত জিহাদি গণসমাবেশে প্রদান করেন। প্রায় বিশ মিনিটব্যাপী এ খুতবা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অতি গুরুত্ব ও মর্যাদার অধিকারী, কেননা বক্তব্যটি সব দিকের সুস্পষ্ট জবাব বহন করেছে।

আমি এ বিষয়ে দীর্ঘ লিখতে চাই না, কারণ সেই বক্তব্য আমাদের বিশ্লেষণ ও ব্যক্তিগত মতের ঊর্ধ্বে। সেটি এমন এক বক্তৃতা, যা ইসলামী ইমারাতের এক নেতার ইমারাত সম্পর্কিত আদর্শিক, ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, সামরিক ও মানসিক উপলব্ধির গভীরতা এবং দৃঢ় ব্যাখ্যার ফসল, যার বিশ্লেষণও তদরূপ একজন বিশ্লেষক প্রাপ্য। তবুও, বর্তমান সময়ের গুরুত্বের কারণে আমি আমার সীমিত ভাবনা ও সরল ভাষায় চেষ্টা করছি বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো আলাদা অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে প্রতিটি অনুচ্ছেদকে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, সামরিক ও মানসিক সংগ্রামের কাঠামোর মধ্যে স্থাপন করে তাতে নিহিত বার্তাগুলো স্পষ্ট করার।

প্রথম অনুচ্ছেদ
“আল্লাহ তায়ালার শোকর যে আজ আমরা ও আপনারা এক মর্যাদাপূর্ণ সমাবেশে এবং জিহাদ ও সংগ্রামের এক সুদৃঢ় মোরচায় উপস্থিত হয়েছি ও একত্রিত হয়েছি।”
এ অংশ আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায়কে কেন্দ্র করে, যা একটি ইসলামী নীতি এবং এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে সবকিছুই আল্লাহর অনুগ্রহ। পরে “জিহাদ, সংগ্রাম ও মোরচা” শব্দসমূহ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে এগুলি অতি উচ্চ ধর্মীয় মূল্যবোধ; মুসলিমদের রক্ষা ও দীনের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য জিহাদই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মহৎ কর্ম।
এ পরিভাষাগুলো আমাদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিক সংগ্রামের দিকে ইঙ্গিত করে এবং মুজাহিদদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তারা এক “পবিত্র” মিশনে নিয়োজিত, যাতে অবিচল থাকা আবশ্যক। এটি মুজাহিদের জন্য চিন্তার দৃঢ়তা সঞ্চারের প্রধান উপাদান।

সমাবেশকে “মোরচা”র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা এক শক্তিশালী প্রতীক—এটি শুধু এক সাধারণ সমাবেশ নয় বরং এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম। এটি কোনো সাধারণ চিন্তাধারা বা সামাজিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং সামরিক মঞ্চের মর্যাদায় মর্যাদাবান।

দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
“আমাদের ও আপনাদের পিতৃপুরুষ সোভিয়েত, ইংরেজ এবং অন্যান্য আগ্রাসী ও যালিম সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং এভাবে মুসলিম জাতি হিসেবে আফগানিস্তানের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছিলেন।”
এ অংশে স্পষ্ট হয়েছে যে আমাদের যুদ্ধ ও সংগ্রাম কেবল জাতীয় নয়, বরং ধর্মীয়, যার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের পবিত্র দীন ও মুসলিম জাতির পবিত্র পরিচয়ের সংরক্ষণ।

ইংরেজ ও সোভিয়েত দখলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উল্লেখ আফগান প্রতিরোধের ঐতিহাসিক ধারার দিকনির্দেশ করে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারাবাহিকতার অনুভূতি জাগ্রত করে। এতে বার্তা দেওয়া হয়েছে—আজকের সংগ্রাম ও জিহাদও সেই ধারার অংশ। অতএব, যদি কেউ আবারো আক্রমণ চালায়, তবে সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, কারণ জিহাদ ও সংগ্রাম আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় পরিচয়।

তৃতীয় অনুচ্ছেদ
“শাহাদাতের মাধ্যমে এক মুসলিম প্রমাণ করে যে তার কাছে ইসলামই সর্বাধিক মূল্যবান…”
এ অংশ শাহাদাতের পবিত্র মূল্যকে ঘিরে আবর্তিত। ইসলাম রক্ষার্থে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সর্বোচ্চ মহিমা; মুজাহিদের জন্য এতে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। এখানে জিহাদ ও শাহাদাতের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্পষ্ট করা হয়েছে এবং মুজাহিদদের আত্মত্যাগের মহিমা তুলে ধরা হয়েছে, যারা তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ইসলামী মূল্যবোধের অমর প্রতীক হয়ে ইতিহাসে অঙ্কিত হয়েছেন।

এটি শত্রুকেও বার্তা দেয়—তাদের মুখোমুখি এমন এক জাতি, যারা দুনিয়ার ওপর নয়, বরং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের ওপর বিশ্বাসী। এ বিশ্বাস সংগ্রামীদের জন্য নৈতিকতার সবচেয়ে দৃঢ় আশ্রয়, আর যে বাহিনী মৃত্যুকে ভয় করে না, তাকে পরাজিত করা দুঃসাধ্য।

চতুর্থ অনুচ্ছেদ
“এটি শাহাদাতের ভূমি… এটি আত্মত্যাগের ভূমি।”
এ অংশে এ ভূমির মহিমান্বিত ইতিহাস ও সংগ্রামের পবিত্রতা বিবৃত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে এ ভূমি আল্লাহর পথে শির কুরবানির গৌরব ধারণ করেছে এবং এর অধিবাসীরা কখনোই নিজেদের মূল্যবোধ ও তার রক্ষার্থে আত্মোৎসর্গ থেকে পিছু হটেনি।

এটিও ইতিহাসের কাঠামো উপস্থাপন করে—এ ভূমির সুরক্ষা সর্বদা কুরবানির মাধ্যমে হয়েছে। এতে আফগানদের অহংকার, স্বাধীনতা ও অবিচলতার বার্তা নিহিত, একইসঙ্গে সৈনিকদের উদ্দেশে বলা হয়েছে আপনারা এই কুরবানির উত্তরাধিকারী, এবং প্রতিটি যালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সেই পথে অটল থাকতে হবে।

পঞ্চম অনুচ্ছেদ
“আমাদের ও আপনাদের শত্রুরা যখন কঠিন পরাজয়ের মুখোমুখি হলো, তখন তারা চিন্তাগত ও মানসিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো।”
এ অংশে শত্রুর মোকাবিলার আরেক অধ্যায় প্রকাশ পেয়েছে। যখন তারা সামরিক যুদ্ধে ব্যর্থ, তখন তারা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটি এক কৌশলগত ইঙ্গিতও, প্রত্যেক শক্তিই সামরিক ব্যর্থতার পর মতাদর্শিক হামলার পথ অবলম্বন করে। অতএব, প্রচারণার প্রভাবে না পড়ে, চিন্তার সংগ্রামে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য।

ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ
আল্লাহর কসম আমার কাছে এটি প্রিয় যে, আমি আল্লাহ তায়ালা ও এ শরঈ ব্যবস্থার রক্ষায় কণাকণায় পরিণত হয়ে যাই…”
এ অংশ অতীব হৃদয়স্পর্শী। এটি কেবল শপথ নয়, বরং জনগণ ও সহযোদ্ধাদের প্রতি অঙ্গীকার, শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা, ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও ইসলামী বিধানের বাস্তবায়নে দৃঢ়তার প্রকাশ। এ দীনী দৃঢ়তা মহান ঈমানের প্রতীক।

এ শপথ নেতা চরিত্রকেও স্পষ্ট করে। প্রয়োজনে তিনি নিজেকে বিনষ্ট করতেও প্রস্তুত, তবুও পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না। এতে শত্রুকে বার্তা দেওয়া হয়েছে নেতা নিজেই আত্মত্যাগে অগ্রণী। সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেছেন আমি সর্বদা কুরবানির প্রথম কাতারে আপনাদের সঙ্গী।

সপ্তম অনুচ্ছেদ
“আমরা দৃঢ়ভাবে সেই সকল বিষয়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াব, যা আমাদের ব্যবস্থার স্থায়িত্ব ও বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়…”
এ অংশ স্পষ্ট করে ইসলামী ইমারাত একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যবস্থা। মানবনির্মিত ব্যবস্থার বিরোধিতা করা এর নীতিগত অবস্থান। এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রত্যেক প্রয়াসকে শত্রুতা ও আক্রমণ গণ্য করা হবে। এটি ঘোষণা করে—ইমারাত রক্ষায় কোনো অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত চাপের কাছে নতি স্বীকার করা হবে না; প্রতিটি হুমকির জবাব শক্তি দিয়ে দেওয়া হবে।

অষ্টম অনুচ্ছেদ
“আপনাদের যুবকরা, আপনাদের পুত্ররা, আপনাদের হৃদয়ের টুকরোগুলোকে আল্লাহ তায়ালা শাহাদাতের জন্য মনোনীত করেছিলেন…”
এ অংশে হারানো সহযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি গভীর বেদনা প্রতিফলিত, কিন্তু শাহাদাতকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচনের রূপে উপস্থাপন করে তা এক প্রশান্তি দান করেছে। এটি সুস্পষ্ট করে—তাদের আত্মোৎসর্গ বিফলে যায়নি, বরং তাদের সহযোগিতা অনবরত সামরিক সমর্থনের নিশ্চয়তা।

নবম ও শেষ অনুচ্ছেদ
“এসো, আমরা ইসলামী ইমারাত ও আমীরুল মু’মিনীন হাফিযাহুল্লাহর পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াই…”
এ অংশে স্পষ্ট ভাষায় জনগণকে আমীরুল মু’মিনীনের আনুগত্যের আহ্বান জানানো হয়েছে, যা ধর্মীয়ভাবে অপরিহার্য এবং ইমারাতের ঐক্যের প্রতীক। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে সকলকে ইমারাতের ঐক্য ও আনুগত্যে সমবেত হতে হবে। বহিরাগত প্রচারণা ও মতাদর্শিক প্রভাব থেকে জনগণের মানসিকতা রক্ষা এবং ঐক্য নীতির প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। আনুগত্যকে প্রতিটি সামরিক কাঠামোর স্থায়িত্বের অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

 

Exit mobile version