ইসলামের উদ্ভবলগ্ন থেকেই আরব ভূখণ্ডে এক গভীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রূপান্তর সূচিত হয়; উপজাতিকেন্দ্রিক এক বিকীর্ণ সমাজ পরিণত হয় এক সংহত, সুসংবদ্ধ এবং সভ্য জাতিতে। ইসলামী পরিচয়ের আলোকে পরিবারনীতি, দণ্ডবিধি, অর্থনৈতিক লেনদেন ও অন্যান্য বিধিবিধানের ভিত্তিতে এক ছিন্নমূল উপজাতিক কাঠামো রূপ নেয় একটি ঐক্যবদ্ধ উম্মতের অনুপম রূপে। ইসলামী শরীয়তের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গড়ে ওঠে এমন এক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা জনসাধারণকে সামষ্টিক কল্যাণ, মৌলিক মানবিক অধিকার এবং অন্যান্য মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ও ইসলামের দাওয়াতের মৌলিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে তোলে।
ইসলামের মহীয়ান নবী মুহাম্মাদ ﷺ এই মহান অভিযাত্রার পথপ্রদর্শক ও রূপকার হিসেবে এমন এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন, যিনি শুধু মুসলিম সমাজকেই নয়, বরং বহির্বিশ্বের অমুসলিম সমাজকেও আলোড়িত করেন। তাঁর সুদূরদর্শী রাষ্ট্রনীতি ও অনুপম ব্যবহারে জিহাদের ব্যতিরেকেও তিনি আপনজন ও পরজনের হৃদয় জয় করেন। তিনি ইসলামের বিধিবিধানকে কেন্দ্র করে একটি নীতিনির্ভর জীবনচর্চা ও মানবজাতির সঙ্গে ন্যায়ের ভিত্তিতে আন্তঃসম্পর্কের এক বৈশ্বিক আদর্শ নির্মাণ করেন।
রাসূল ﷺ-এর এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এমনকি ইউরোপের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর চিন্তানায়কদেরও অভিভূত করে। জাঁ জাক রুসো, ভলতেয়ার, শোপেনহাওয়ার প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা এই প্রসঙ্গে অকপটে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। তাঁদেরই একজন মার্সেল তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন: “ইসলামের বৈশ্বিক দর্শন দুই মহান মৌলিকত্ব দ্বারা অভিষিক্ত— এক, আল্লাহর প্রতি ঈমান; এবং দুই, জাতি, বর্ণ ও গোত্রভিত্তিক উগ্রতা ও শ্রেষ্ঠত্বের সমস্ত অহমিকা পরিত্যাগ করে মানবসমাজে সাম্যের সর্বোচ্চ ঘোষণা।”
এই মহান আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে রাসূল ﷺ মক্কার জাহেলি আরব ও ইয়াহুদি গোত্রসমূহের জাতি ও বর্ণকেন্দ্রিক গর্ববোধ নির্মূল করে দেন। ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম মানবজাতিকে যে সম্মান ও মর্যাদাবোধ দান করতে পারেনি, ইসলাম তা করেছে। এটি ছিল এমন একটি ধর্ম যা ইয়াহুদি-নাসারাদের প্রতিও করুণা ও সৌহার্দ্যের আচরণ করেছে। ইসলাম একটি এমন বিশ্ব নির্মাণে সংকল্পবদ্ধ, যেখানে মানবসমাজ পরস্পর সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সমতার জীবন যাপন করবে।
ইসলামের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস অত্যন্ত দীপ্তিময় ও স্পষ্টতাবাহী। এক সময় আরব গোত্রসমূহ এবং হাবশা, আমারাত, হীরা, গাসসান ও সাবার মতো পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্ক ছিল দ্বন্দ্বপূর্ণ ও বিপর্যস্ত। কিন্তু নবী করীম ﷺ সেই সংকটময় প্রেক্ষাপটে আন্তর্জতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এমন এক ভিত্তি স্থাপন করেন, যা তাঁর নবুওতের যুগে তো বটেই, তাঁর ওয়াফাতের পরের যুগেও ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের জন্য বৈশ্বিক লেনদেন ও সুসম্পর্কের এক অনন্য রূপরেখা হয়ে ওঠে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ মীসাক-এ-মাদীনা, সুলহে হুদায়বিয়া, এবং নাজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে চিরস্থায়ী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও বৈদেশিক সম্পর্কের প্রথম স্তম্ভ নির্মাণ করেন। তিনি আরব গোত্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে সংহত করেন। এরপর তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেন, দূত প্রেরণ করেন এবং চুক্তিসমূহ সম্পাদন করেন।
রোম ও পারস্যের মতো দুই পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের দরবারে দূত পাঠানো সে যুগে নিছক এক আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ ছিল না; বরং তা বৈশ্বিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সোপানরূপে বিবেচিত। এই দুই মহাসাম্রাজ্যের সংবেদনশীল রাজনৈতিক পরিসরে ছোট ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আত্মপ্রকাশের সক্ষমতা দান— এই সমগ্র উদ্যোগ নবী করীম ﷺ-এর সুপরিকল্পিত পররাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত। এরই পরিণতিতে রোম ও পারস্য উভয় সাম্রাজ্যই ইসলামের ন্যায়ের পতাকা ও তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক প্রজ্ঞার সামনে অবনত হতে বাধ্য হয়।