ইসলামী ব্যবস্থার সুফল | চতুর্থ পর্ব

✍🏻 আহমাদ রাশেদ আয-যারক্বা

ইসলামী ব্যবস্থার আরও কিছু সুফল

৫. ইসলামী ব্যবস্থা একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা
ইসলামের বার্তা একটি সার্বজনীন বার্তা। এটি সমগ্র মানবজাতি, সব জাতি, সব সামাজিক শ্রেণি ও দায়িত্বের জন্য প্রযোজ্য। এটি কোনো নির্দিষ্ট যুগ, বিশেষ গোষ্ঠী বা সীমিত সময়ের জন্য নয়; বরং এটি মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার দিশা প্রদর্শনের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।

ইসলাম চায় মুসলিমরা একটি বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করুক, যেখানে তারা একক উম্মাহ হিসেবে থাকবে। আর এটি সম্ভব হবে পারস্পরিক সহযোগিতা, ঐক্য এবং আনুগত্যের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদের বহু আয়াতে এ সত্য সুস্পষ্ট করেছেন যে, ইসলামী ব্যবস্থা একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা—
১. قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا
অর্থ: বলুন—হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রসূল। (আল-আ‘রাফ: ১৫৮)
এই আয়াত প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ ﷺ সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন; কেবল কোনো বিশেষ জাতির জন্য নন।

২. وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآنُ لِأُنذِرَكُم بِهِ وَمَن بَلَغَ
অর্থ: আমাকে এই কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে যাতে এর মাধ্যমে আমি তোমাদের এবং যাদের নিকটই এটি পৌঁছে তাদের সবাইকে সতর্ক করি। (আল-আন‘আম: ১৯)

৩. وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
অর্থ: আমি আপনাকে সমস্ত জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।

৪. وَمَا هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعَالَمِينَ
অর্থ: এ কুরআন তো সমগ্র বিশ্বের জন্য উপদেশ ও উপমা ছাড়া আর কিছু নয়।

এছাড়া নবী ﷺ বলেছেন—
وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً
অর্থ: পূর্ববর্তী নবীগণ কেবল তাদের নিজ নিজ জাতির জন্য প্রেরিত হতেন; কিন্তু আমি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি।

যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা, তাই এতে কোনো বিলোপ, পরিবর্তন বা সংশোধনের সুযোগ নেই। এ ব্যবস্থার দাবি হলো, প্রতিটি যুগে ও প্রতিটি স্থানে বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে এটি কার্যকর থাকবে। আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদ ও নাসারাদের ব্যাপারে, যাদের দায়িত্ব কেবল বনী ইসরাঈলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এভাবে বলেছেন:
فَأْتِيَا فِرْعَوْنَ فَقُولَا إِنَّا رَسُولُ رَبِّ الْعَالَمِينَ أَنْ أَرْسِلْ مَعَنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ
অর্থ: (হে মূসা ও হারুন!) তোমরা ফিরআউনের কাছে যাও এবং বলো—আমরা বিশ্বজগতের রবের রসূল, তাই বনী ইসরাঈলকে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দাও।

অতএব ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসেনি; বরং এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। এর রাজনৈতিক ব্যবস্থাও বিশ্বব্যাপী, পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ীভাবে প্রণীত, কেননা সমগ্র মানবজাতিই এক আল্লাহর দাস, এবং সবারই তাঁর দিকনির্দেশনার প্রয়োজন।

৬. ইসলামী ব্যবস্থা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থী ব্যবস্থা
ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সামঞ্জস্য ও সংযম। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِّتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ
অর্থ: আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাহ বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও। (আল-বাকারাহ: ১৪৩)

ইসলাম একটি মধ্যপন্থী ধর্ম; হোক তা বিশ্বাস, ইবাদত, আখলাক, সামাজিক মূল্যবোধ, চিন্তাধারা কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিক থেকে। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থাও সংযম ও ভারসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত; এর বিপরীতে অন্যান্য ব্যবস্থা হয় চরমপন্থার উপর দাঁড়ানো, যেমন—নিরঙ্কুশ একনায়কতন্ত্র; অথবা শিথিলতার উপর দাঁড়ানো, যেমন নিরঙ্কুশ গণতন্ত্র।

ইসলাম স্বীকার করে না যে শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে এক ব্যক্তির হাতে থাকবে, যেমন স্বৈরতন্ত্রে দেখা যায়; আবার এটিও গ্রহণ করে না যে জনগণ কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সবকিছু নিজেরা করবে, যেমন নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রে হয়। বরং ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তায় নেতৃত্ব বা প্রধানকে “আহলুল হাল ওয়াল আকদ”—অর্থাৎ জ্ঞান, তাকওয়া ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের পরামর্শ ও নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত করা হয়।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
خَيْرُ الأُمُورِ أَوْسَطُهَا
অর্থ: কার্যকলাপের শ্রেষ্ঠ পথ হলো মধ্যপন্থা। (বাইহাকী প্রমুখ)

অতএব, ইসলামী ব্যবস্থা চরমপন্থা ও শৈথিল্য—দুটো থেকেই মুক্ত; এটি সংযত, জ্ঞানভিত্তিক ও পরামর্শনির্ভর ব্যবস্থা। এখানে ক্ষমতা একনায়কতান্ত্রিক নয়, আবার সম্পূর্ণ জনতার হাতেও নয়; বরং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও জ্ঞানের আলোকে পরিচালিত। এই ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং প্রতিটি যুগ ও প্রতিটি প্রজন্মের জন্য দ্বীনকে কার্যকর রাখা।

Exit mobile version