আইএস একটি মহামারির নাম

[দ্বাদশ পর্ব]

#image_title

✍🏻 আবু হাজার আল কুর্দি

ইয়ারমুক ক্যাম্পে আইএসআইএসের প্রভাব এবং সুন্নি মুজাহিদীনদের বিরুদ্ধে তাদের কুকীর্তি

এই সিরিজের শুরুতেই আমি উল্লেখ করেছি যে, দাঈশ সুন্নি মুসলিম ও মুজাহিদীনদের জন্য একটি মহামারি ছাড়া আর কিছুই নয়; যেখানেই মুজাহিদীনরা ক্ষমতায় থাকতেন, সেখানেই এই অশুভ কীট আবির্ভূত হয়ে ইসলামের যুবকদের উপর আক্রমণ করত।

আইএসআইএসের দখলে থাকা জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ইয়ারমুক ক্যাম্প।

ইয়ারমুক ক্যাম্পটি সিরিয়ার রাজধানী এবং বাশার আল আসাদের প্রাসাদ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যেটি মুজাহিদীনরা খুব অল্প সময়ে জয় করেছিলেন। এ কারণেই আইএসআইএস এই জায়গাটি দখল করার চিন্তা করেছিল যাতে বাশার আল আসাদ সরকার শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে এবং নিকটে অবস্থানরত মুজাহিদীনদের হুমকি থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

২০১৫–এর শুরুতে ইয়ারমুক ক্যাম্পে আইএসআইএসের প্রবেশকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের একটি সংবেদনশীল এবং জটিল কারণ বলে মনে করা হয়। ইয়ারমুক ক্যাম্প— যা ১৯৫০–এর দশকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের থাকার জন্য নির্মিত হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে এটি সিরিয়ার সবচেয়ে বড় ফিলিস্তিনি বসতিতে পরিণত হয় পাশাপাশি এটি পারস্পরিক দ্বন্দ্বের একটি প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।

আইএসআইএসের উপস্থিতির পূর্বে ইয়ারমুক ক্যাম্পের অবস্থা:
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ইয়ারমুক ক্যাম্প দামেস্ক শহরের নিকটবর্তী এবং জনসংখ্যায় অধিক হওয়ার কারণে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্য একটি কৌশলগত এলাকা হয়ে ওঠে।

প্রথমে আসাদ বিরোধী গোষ্ঠীগুলো যেমন “ফ্রি সিরিয়ান আর্মি” এবং পরে “জাবাহাতুন নুসরাহ” ক্যাম্পের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

সেই সময়কালে ক্যাম্পটি সিরিয়ার সরকারী বাহিনী দ্বারা ব্যাপকভাবে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল, ইয়ারমুকবাসীর জীবনকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছিল। বাসিন্দাদের খাদ্য, চিকিৎসা সেবা এবং ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল।

ইয়ারমুকে আইএসের প্রবেশ:
২০১৫ সালের এপ্রিলে ফিলিস্তিনি জিহাদি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আন্তঃসংঘাতের সুযোগ নিয়ে আইএসআইএস ক্যাম্পে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।

কিছু সূত্র দাবি করে যে, আইএসআইএস ইয়ারমুকে “আকনাফে বাইতুল মাকদিস” (হামাসের সাথে সম্পৃক্ত একটি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী যেটি সিরিয়া সরকার বিরোধী) গ্রুপের যোগসাজশে প্রবেশ করেছিল; কিন্তু এই দাবি সত্য ছিল না কারণ পরবর্তীতেই তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ শুরু করে।

ইয়ারমুকে দাঈশের প্রবেশের সফলতা বিভিন্ন জিহাদি গোষ্ঠীর সাথে প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল।

ইয়ারমুকে আইএসআইএসের লক্ষ্যবস্তু:

১. কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ:
ইয়ারমুক ক্যাম্পটি দামেস্কের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এলাকাটি আইএসআইএস দখল করতে চেয়েছিল যাতে সিরিয়ার রাজধানীর চারপাশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার পাশাপাশি বাশার আল আসাদ সরকারকে নিরাপত্তা দিতে পারে।

২. নতুন লোক নিয়োগ এবং মুজাহিদীনদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার:
আইএসআইএস তরুণদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিল যাতে তারা জিহাদি দলগুলিতে যোগ না দেয় এবং জিহাদি দলগুলিকে দুর্বল করে দেয়। এই কারণেই সরকারী বাহিনী সেই দিনগুলিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ছিল।

৩. অন্যান্য জিহাদি দলের সাথে প্রতিযোগিতা:
তখন ইয়ারমুকে সিরিয়া সরকারের বিরোধী বেশ কয়েকটি দল ছিল, যার মধ্যে জাবাহাতুন নুসরাহ ছিল অন্যতম; ইয়ারমুকে প্রবেশ করে দাঈশ কেবল নতুন অঞ্চল দখলের চেষ্টাই করেনি বরং অন্যান্য ইসলামপন্থী এবং সশস্ত্র জিহাদি গোষ্ঠীর উপর তার শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টাও করেছে।

যদিও মুজাহিদীনদের প্রতি হাজারো অত্যাচার ও নৃশংসতা করার পর আইএসআইএস ক্যাম্পের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়; কিন্তু তারা কখনো বাশার আল আসাদের বাহিনীর ওপর একটি গুলিও চালায়নি। দাঈশের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা সবসময় মুজাহিদীনদেরকেই টার্গেট করেছে।

৪. মানবিক সংকটের সুযোগ নেওয়া:
আইএসআইএস মূলত সঙ্কট পরিস্থিতির সুযোগ নেয় ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ পেতে। যেমন অবরোধ এবং দুর্ভিক্ষ; ইয়ারমুকে সরকারী বাহিনীর দীর্ঘ অবরোধ এবং অচলাবস্থা আইএসআইএসকে একটি শক্তিশালী এবং সম্ভাব্য ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।

প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল:
ইয়ারমুকে আইএসআইএসের প্রবেশ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভীতি ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। আইএসআইএস দ্রুত ক্যাম্পের বড় একটি অংশ দখল করে নেয় এবং ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং জাবাহাতুন নুসরাহর সাথে ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সরকারি বাহিনীর ব্যাপক অবরোধ সত্ত্বেও আইএসআইএস ইয়ারমুক ক্যাম্পের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারেনি।

ইয়ারমুক ক্যাম্পে আইএসআইএসের উপস্থিতি বেশ কয়েক মাস ধরে চলেছিল, যা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অনেক ক্ষতি করেছিল। অবিরাম যুদ্ধ এবং দরিদ্র জীবনযাত্রা ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দাকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল ফলে আইএসআইএস ধীরে ধীরে তার বাহিনী হারায়।

ইয়ারমুকে আইএসআইএসের উপস্থিতি ছিল তাদের যুদ্ধ কৌশলের উদাহরণ, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় বিশৃঙ্খলা ও জনগণের অসন্তোষের সুযোগ নেয়। যার মূল উদ্দেশ্য কৌশলগত অবস্থানে আধিপত্য বিস্তার করা আর সংকট পরিস্থিতি থেকে নিজের প্রভাব বাড়াতে থাকা।

Abu Jundab Abdullah
Exit mobile version