ফিলিস্তিন বিষয়ক ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পরিকল্পনা!

বিশ্লেষণ: মাওলানা আবদুস সামাদ শাকির

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিন সম্পর্কে একটি নতুন পরিকল্পনা পেশ করেছে, যা এই সমস্যাকে আরেকটি নতুন মোড়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। এই পরিকল্পনা ইসলামী দেশগুলোর নেতা ও চিন্তাবিদদের গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ ও গভীর চিন্তাভাবনার দাবি রাখে। আমার মতে, জেরুজালেম (বাইতুল মুকাদ্দাস) সম্পর্কে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যকার পুরোনো সংঘাত এখন এক নতুন রূপে সামনে এসেছে।

খ্রিস্টান পক্ষ, যারা এর আগে পর্দার আড়ালে থেকে গত শত বছরে ইহুদিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুসলিম ও ইয়াহুদিদের মধ্যকার চলমান দ্বন্দ্বে সহযোগিতা করেছে, তারা এখন প্রকাশ্যে ময়দানে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো সম্পূর্ণ বিষয়টি নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া। এই লক্ষ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং টনি ব্লেয়ারকে সামনে রাখা হয়েছে এবং বেশিরভাগ ইসলামী দেশের শাসকরাও তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন বলে মনে হয়। এভাবে জেরুজালেম সম্পর্কে মুসলিম ও ইয়াহুদিদের পরিবর্তে খ্রিস্টানদের আধিপত্যের ভিত্তি স্থাপন করা হচ্ছে। তাই এই সম্পূর্ণ দৃশ্যপটকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা দরকার।

আরব বিশ্বের বর্তমান শাসকদের কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট ও কার্যকর অবস্থান আশা করা যায় না; তবে ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আবশ্যক যে তারা বিগত আড়াই হাজার বছরের পরিস্থিতি নতুন করে পর্যালোচনা করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবেন। আমরাও ইনশাআল্লাহ এই বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত মতামত পরে পেশ করব। কিন্তু আপাতত আমরা পাঠকের সামনে ২০০০ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ এবং ২০০২ সালে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে শর্তসাপেক্ষে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব সম্পর্কিত কিছু বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরছি:

১. মসজিদুল আকসার ইতিহাস
বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজের সফরের গন্তব্যও এই স্থানটি ছিল। মদিনা মুনাওয়ারার দিকে হিজরতের পর প্রায় সতেরো মাস পর্যন্ত এটি মুসলিমদের কিবলা ছিল, এই কারণে একে “প্রথম কিবলা” বলা হয়। তবে মসজিদে সখরার ইতিহাস উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের আমল থেকে শুরু হয়।

বর্ণনা অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজের রাতে এই স্থান থেকেই তার আসমানি সফর শুরু করেছিলেন। এই স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করার জন্য খলিফা আবদুল মালিক এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন।

এই বিষয়ে আমরা দুটি নির্ভরযোগ্য বই থেকে তথ্য নিচ্ছি, প্রথমটি হলো আরিফ পাশা আল-আরিফের “তারিখে আল-কুদস” (চার খণ্ডের বিশাল গ্রন্থ), যা মসজিদুল আকসার ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য।

এবং দ্বিতীয় বইটি হলো শায়খ ত্বহা আল-ওয়ালীর রচনা “আল-মসজিদ ফিল ইসলাম”, যেখানে মসজিদুল আকসা সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এই বইগুলোর আলোকে জানা যায় যে ৭৪ হিজরিতে খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং ৮৬ হিজরিতে খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিকের আমলে এই কাজ সম্পন্ন হয়। এই বিশাল প্রকল্পে মিশরের সাত বছরের খাজনার পুরো আয় ব্যয় করা হয়েছিল। নির্মাণ কাজের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন রাজা বিন হাইওয়া আল-কিন্দি এবং ইয়াযিদ বিন সালাম।

মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হলে নির্দিষ্ট বাজেট থেকে এক লাখ দিনার বেঁচে যায়। খলিফা এই টাকা দুই তদারককারীকে পুরস্কার হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, তাদের অধিকার পুরস্কার নেওয়া নয়, বরং তাদের স্ত্রীদের গহনা বিক্রি করে মসজিদে খরচ করা। ফলস্বরূপ, খলিফা সেই এক লাখ দিনার গলিয়ে মসজিদের দরজাগুলোতে সোনার সূক্ষ্ম ও আকর্ষণীয় পরত লাগিয়ে দেন।

১৩০ হিজরিতে এক তীব্র ভূমিকম্প হয় যা বিভিন্ন শহরের ক্ষতি করে। তৎকালীন খলিফা আবু জাফর মসজিদে সখরার দরজা থেকে সোনার সেই পরতগুলো তুলে পুনরায় দিনারে রূপান্তর করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। ১৬৩ হিজরিতে খলিফা মাহদি বিন জাফর মসজিদের সীমানায় পরিবর্তন আনেন; এর প্রস্থ কমিয়ে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করেন।

৪২৬ হিজরিতে খলিফা আল-যাহির তার সময়ের ভূমিকম্পের কারণে মসজিদটি পুনরায় মেরামত করান এবং এই সময়েই নতুন গম্বুজটিও নির্মাণ করেন যা আজও বিদ্যমান। এছাড়াও তিনি উত্তর দিকে সাতটি দরজা নির্মাণ করেন।

৪৯২ হিজরিতে ক্রুসেডাররা বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়। মসজিদে সখরাকে চার্চে রূপান্তরিত করা হয়। এর এক অংশ ঘোড়ার আস্তাবল এবং অন্য অংশ গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। বলা হয় যে সেই সময় সখরার গম্বুজের টুকরোগুলো খসে পড়ত এবং ক্রুসেডাররা সেই টুকরোগুলো তাদের এলাকায় নিয়ে যেত ও সোনার বদলে বিক্রি করত।

৪৯২ হিজরি থেকে ৫৮৩ হিজরি পর্যন্ত বাইতুল মুকাদ্দাস ক্রুসেডারদের দখলে ছিল, তবে ৫৮৩ হিজরিতে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী তাদের কবল থেকে একে মুক্ত করেন। আইয়ুবী মসজিদের মেরামত করার পাশাপাশি ক্রুসেডার আমলের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলেন এবং আলেপ্পোর জামে মসজিদের জন্য প্রস্তুত করা বিশেষ মিম্বরটি মসজিদুল আকসায় স্থাপন করেন। ৫৯৫ হিজরিতে প্রথমবারের মতো আইয়ুবী পরিবারের নির্দেশে মসজিদটি গোলাপের নির্যাস দিয়ে ধোয়া হয়।

৬৩৪ হিজরিতে মালিক ঈসা এবং ৬৮৬ হিজরিতে মালিক আল-মনসুর সাইফুদ্দীন মসজিদে আরও সম্প্রসারণ ও প্রয়োজনীয় মেরামত করান। ৮৬৫ হিজরিতে নাযিরুল হারামাইন আমির আবদুল আযীয ইরাকীর সময়কালে পুনরায় মেরামত করা হয়। ৯৬৯ হিজরি থেকে ১৩৪১ হিজরি পর্যন্ত বাইতুল মুকাদ্দাস এবং মসজিদে সখরা উসমানী খলিফাদের অধীনে ছিল এবং সময়ে সময়ে এতে পরিবর্তন আনা হয়।

১৯২২ সালে ফিলিস্তিনের গ্র্যান্ড মুফতি হাজী আমীন আল-হুসাইনী তুর্কি প্রকৌশলী কামাল উদ্দিন বেগের তত্ত্বাবধানে মসজিদটি পুনরায় নির্মাণ ও মেরামত করান। এই উদ্দেশ্যে মক্কার নেতা হুসাইন বিন আলীর বিশেষ সহযোগিতা ছাড়াও ফিলিস্তিন, মিশর, সিরিয়া, কুয়েত, বাহরাইন এবং আমেরিকায় বসবাসকারী আরবদের চাঁদা ও বাইতুল মুকাদ্দাসের জন্য বরাদ্দকৃত আয় ব্যবহার করা হয়।

১৯৪৫ সালে ইয়াহুদিরা মসজিদের ভেতর বোমা নিক্ষেপ করে, যার ফলে বাবুল আওসাত দরজাটি ভেঙে যায় এবং গম্বুজের মারাত্মক ক্ষতি হয়। ১৯৬৭ সালে মসজিদুল আকসা দখলের পর ইয়াহুদিরা আবারও ক্ষতি করে এবং বাবুল আওসাত দরজাটি সম্পূর্ণরূপে গুঁড়িয়ে দেয়।

১৯৬৯ সালে মসজিদুল আকসায় আগুন লাগার অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, যার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে শিখা গম্বুজের স্তম্ভ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং গম্বুজটি পুড়ে যাওয়া ও ধসে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এই দুর্ঘটনার সময় ইহুদিরা মসজিদের মিম্বরটিও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে।

বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে যে মসজিদুল আকসার চারটি সুউচ্চ মিনার ছিল, যেগুলোকে বাবুল মাগারিবা, বাবুল সিলসিলা, বাবুল গাওয়ানিমা এবং বাবুল আসিয়াত নামে স্মরণ করা হয়। “মিনার বা মুয়াজ্জিনা” সেই স্থানকে বলা হতো যেখান থেকে আযান দেওয়া হতো। প্রাচীনকালে প্রত্যেক বড় জামে মসজিদের চার কোণে আলাদা আলাদা মিনার তৈরি করা হতো, যাতে মুয়াজ্জিন সেখানে দাঁড়িয়ে আযান দিতে পারেন।

এছাড়াও মসজিদটির দশটি অত্যন্ত সুন্দর দরজা রয়েছে, যাদের নামগুলো হলো: বাবুল আসিয়াত, বাবুল হিত্তা, বাবুশ শারাফ আল-আম্বিয়া, বাবুল গাওয়ানিমা, বাবুন নাযির, বাবুল জালীদ, বাবুল ক্বাত্বানীন, বাবুল মুতাওয়াদ্দা, বাবুল সিলসিলা এবং বাবুল মাগারিবা। তবে এর চারটি দরজা এখনও বন্ধ রয়েছে: বাবুস সকীনাহ, বাবুল আকসা, বাবুত তাওবা এবং বাবুল বুরাক্ব।

মসজিদের আয়তনও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫০ মিটার এবং প্রস্থ ২৬০ মিটার। পূর্ব দিকে এর সীমা ৪৭৪ মিটার, পশ্চিমে ৪৯০ মিটার, উত্তর দিকে ৩২১ মিটার এবং দক্ষিণ অর্থাৎ কিবলার দিকে ২৮৩ মিটার। এই ঐতিহাসিক বইগুলোতে মসজিদুল আকসার মর্যাদা এবং এর পুনরায় বিজয়ের বিষয়ে মুমিনদের আবেগও বর্ণনা করা হয়েছে।

২. ফিলিস্তিন সমস্যা: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও মুসলিম বিশ্বের নীতিগত অবস্থান
২০০০ সালে সৌদি আরবের তৎকালীন যুবরাজ প্রিন্স আবদুল্লাহ এই প্রস্তাব দেন যে, যদি ইসরায়েল আরবদের কাছে দখল করা ভূমি ফিরিয়ে দেয়, তবে সৌদি আরব ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেবে।

সেই সময় প্রিন্স আবদুল্লাহর এই প্রস্তাব ইসরায়েল সংক্রান্ত আরব বিশ্বের নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এর কারণ ছিল, যদি ইসরায়েল দখল করা ভূমি ফিরিয়ে দিত এবং সৌদি আরব এটিকে স্বীকৃতি দিত, তবে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর জন্যও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে কোনো বাধা থাকত না, এবং এভাবে ইসরায়েল একটি ইয়াহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামী ও আরব বিশ্বের মধ্যে একটি আইনসম্মত ও বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত।

প্রিন্স আবদুল্লাহর এই প্রস্তাবে কেবল আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং অন্যান্য মার্কিন নেতারাই খুশি হয়নি এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেনি, বরং ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোশে কাটসাভও এটিকে একটি ইতিবাচক প্রস্তাব বলে আখ্যায়িত করে। সে এই প্রস্তাব নিয়ে আরও স্পষ্টতা ও আলোচনার জন্য প্রিন্স আবদুল্লাহকে জেরুজালেম আসার বা নিজে সৌদি আরব সফরের আগ্রহের বার্তা পাঠায়। উভয় পক্ষই এই বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিল।

ফিলিস্তিনের ইতিহাসের সূচনা ইসলামের বিজয়গুলোর সঙ্গে জড়িত। সর্বপ্রথম হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু ১৩ হিজরিতে ফিলিস্তিনের দিকে সেনা প্রেরণ করেন। তিনি গাযযা দখলের পর কায়সারিয়া অবরোধ করেন, কিন্তু রোমানদের একটি বড় সৈন্যদল আসায় সাময়িকভাবে পিছু হটতে হয়। পরবর্তীতে আরও মুজাহিদ তলব করা হয় এবং আজনাদাইনের স্থানে রোমানদের পরাজিত করা হয়। এর ফলস্বরূপ সবতিয়া, নাবলুস, লুদ্দ, আমওয়াস এবং বাইত জিবরিনসহ বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনি শহর বিজয় হয়। অবশেষে ১৭ হিজরিতে বাইতুল মুকাদ্দাসও বিজয় হয় এবং এরপর কায়সারিয়া অবরোধ করা হয়।

এই সময় হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ইয়াযিদ বিন আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুর ওপর অর্পিত হয়। তাঁর ইন্তেকালের পর এই দায়িত্ব তাঁর ভাই হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে আসে। তাঁর নেতৃত্বে কায়সারিয়া এবং আসকালান বিজয় হয় এবং এভাবে ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ক্রুসেডার বাহিনী বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়; কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহ ৮০ বছরের ক্রুসেডার আধিপত্যের পর শহরটি পুনরায় জয় করেন এবং সেখানে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সময় থেকে ফিলিস্তিন একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে উম্মতে মুসলিমার অংশ ছিল।

এরপর ১৫১৭ সালে উসমানী সাম্রাজ্যের সুলতান সালিম প্রথম ফিলিস্তিনকে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ফিলিস্তিন প্রায় চারশো বছর ধরে উসমানী খেলাফতের একটি প্রদেশ ছিল। এই সময়ে ইয়াহুদিরা চেষ্টা করে যে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করবে, যাতে একটি ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, কিন্তু উসমানী খেলাফত এর অনুমতি দেয়নি। সুলতান আবদুল হামিদ দ্বিতীয়ের সময়ে ইয়াহুদিদের বিশ্ব সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাব দেয় যে, যদি ইয়াহুদিদের ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়, তবে তারা উসমানী খেলাফতের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করতে প্রস্তুত; কিন্তু সুলতান আবদুল হামিদ দ্বিতীয় এই প্রস্তাব কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইয়াহুদিদের ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেননি।

ইয়াহুদি ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ কেবল সুলতান আবদুল হামিদই খেলাফত থেকে বঞ্চিত হননি, বরং কিছুদিন পর উসমানী খেলাফতের বিলুপ্তিও ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইয়াহুদিরা জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেন এবং তার মিত্রদের সমর্থন করে, এবং শর্তগুলোর মধ্যে এটাও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে ফিলিস্তিনকে ইয়হুদিদের জাতীয় স্বদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং সেখানে তাদের বসতি স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এবং তার মিত্র উসমানী খেলাফতের পরাজিত হওয়ার পর ব্রিটেন ফিলিস্তিন দখল করে এবং সেখানে তার সরকারি ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন “বালফোর ঘোষণা”-এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে ইয়াহুদি জাতীয় স্বদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং দখলের পর একজন ব্রিটিশ ইয়াহুদিকে এখানকার হাই কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করে, যিনি ফিলিস্তিনে ইয়াহুদিদের বসতি স্থাপনে সাহায্য করেন। এই উদ্দেশ্যে আমেরিকায় ইয়াহুদি সংগঠনগুলো লক্ষ লক্ষ ডলার সরবরাহ করে, এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইয়াহুদিদের ফিলিস্তিনে স্থানান্তর করা হয়, পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জমিগুলো ইয়াহুদিদের হাতে চলে যায়।

এই সময় মুসলিম বিশ্বের বিশিষ্ট এবং শীর্ষস্থানীয় ওলামাগণ ফাতাওয়া এবং সুপারিশের মাধ্যমে চেষ্টা করেন যে ফিলিস্তিনিরা যেন তাদের জমি ইয়াহুদিদের কাছে বিক্রি না করেন, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করেন এবং কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ ইয়াহুদি ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করে। ফলস্বরূপ ইয়াহুদিরা সংগঠিত সশস্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এবং ফিলিস্তিনিরাও সংগঠিত হয়, যার কারণে উভয়ের মধ্যে দাঙ্গা, খুন-খারাবি এবং সংঘাত শুরু হয়।

১৯৪৮ সালে ব্রিটেন জাতিসংঘের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা তাদের সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেবে। এক অংশ ইয়াহুদিদের দেওয়া হয় যা তাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়, আর অন্য অংশ আরব রাষ্ট্র হিসেবে নির্ধারিত হয়। এই সময় জর্ডান বাইতুল মুকাদ্দাস এবং জর্ডানের পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, যার ফলস্বরূপ বাইতুল মুকাদ্দাস জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল মিশর, সিরিয়া এবং জর্ডানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং এই তিনটি দেশের কিছু এলাকা দখল করে নেয়, যার ফলস্বরূপ মুসলিমদের প্রথম কিবলা পুনরায় কাফেরদের দখলে চলে যায়। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিশর ইসরায়েলের দ্বারা দখলকৃত এলাকাগুলো পুনরায় ফিরে পায়, কিন্তু বাইতুল মুকাদ্দাসসহ বেশিরভাগ এলাকায় ইসরায়েলের দখল বজায় থাকে।

২০০০ সালের সময় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সম্পর্কে তিনটি অবস্থান বিশ্বজুড়ে প্রধান ছিল:
১. ইসরায়েলের অবস্থান
ইসরায়েল আমেরিকার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ এবং কার্যত সমর্থন লাভ করেছিল। ইসরায়েল বলত যে, যে অঞ্চলগুলো তার দখলে রয়েছে তা ইসরায়েলের অংশ এবং বাইতুল মুকাদ্দাসসহ কোনো এলাকা খালি করতে তারা প্রস্তুত নয়। ইসরায়েল বাইতুল মুকাদ্দাসকে তার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং “গ্রেটার ইসরায়েল”-এর পরিকল্পনার অধীনে যে মানচিত্রের প্রচার করা হয়েছিল, তাতে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সৌদি আরবের মদিনা মুনাওয়ারা এবং খায়বারসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ইসরায়েলের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এর অর্থ হলো এই অঞ্চলগুলো দখল করা এবং ইসরায়েলি রাষ্ট্রকে প্রসারিত করা বিশ্ব জায়োনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

২. দ্বিতীয় অবস্থান
জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো অনুযায়ী, যা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের বিভাজনের সময় পাস হয়েছিল, ইসরায়েলকে তার দখলে থাকা এলাকাগুলো খালি করার দাবি জানানো হয়েছিল। এর অর্থ হলো ফিলিস্তিনের কোনো অংশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ইসরায়েলের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে তারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত এলাকাগুলো ফিরিয়ে দেবে। তুরস্ক, জর্ডান এবং মিশরসহ একাধিক মুসলিম দেশ এই অবস্থানই গ্রহণ করে এবং এই নীতির ভিত্তিতে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়।

৩. তৃতীয় অবস্থান
আফগানিস্তান, সৌদি আরব এবং ইরানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের অবস্থান ছিল যে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মৌলিকভাবে ভুল। এর কারণ ছিল ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের ঘরবাড়ি এবং এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল এবং তারপর তাদের জমি ও বাড়িঘর ব্রিটিশ প্রশাসনের সাহায্যে জোরপূর্বক ইয়াহুদিদের দখলে দেওয়া হয়েছিল। এই কারণে ইসরায়েলকে একটি আইনসম্মত ও বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। এই দেশগুলো বলত যে আরব বিশ্ব এবং ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতের সমাধান ১৯৪৮ সালের নীতির ভিত্তিতে নয় বরং ১৯১৭ সালের অবস্থানের ভিত্তিতে হওয়া উচিত, যখন ফিলিস্তিন একটি সংগঠিত আরব ও মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বিদ্যমান ছিল এবং সেটিকে বিভক্ত করা হয়নি।

এই অবস্থানটি ১৯৪৮ সালে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আযিয আল সৌদ, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে একটি কঠোর চিঠির জবাবে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছিলেন।

আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান সৌদি আরবের বাদশাহ শাহ আবদুল আযিযকে লেখা তার চিঠিতে লিখেছিল যে, তিনি যেন আরব বিশ্বে তার প্রভাব ব্যবহার করেন যাতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে এবং ফিলিস্তিনের বিভাজন সম্পর্কে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে সাহায্য করা হয়। ট্রুম্যান সতর্ক করেছিল যে যদি এমন না হয়, তবে সৌদি আরব এবং আমেরিকার সম্পর্ক প্রভাবিত হতে পারে এবং যে দেশ জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মানবে না, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ একত্রিত হয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে।

এর জবাবে সৌদি আরবের আমির এবং যুবরাজ আবদুল্লাহর বাবা, বাদশাহ আবদুল আযিয আল সৌদ, ট্রুম্যানকে লিখেছিলেন: “ফিলিস্তিনের সমস্যা পুরোনো নয়, যেমন আপনি মনে করেন; বরং এর আসল হকদার আরব জাতি। কিছু জায়োনিস্ট আগ্রাসনকারীদের মধ্যে চলমান যুদ্ধ, যারা ফিলিস্তিনি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু দেশের সাহায্যে তাদের দখল বজায় রাখতে চায়। ফিলিস্তিনের বিভাজন সম্পর্কে অনুমোদিত প্রস্তাব, যাতে বিভিন্ন দেশের অনুমোদন অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং যাতে আপনারও ভূমিকা ছিল, তা কেবল যুলুম এবং অন্যায্য সিদ্ধান্ত, যা সমস্ত আরব দেশ এবং ন্যায়ের সমর্থক দেশগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। অতএব, বর্তমান যুদ্ধের জন্য আরব জনগণ দায়ী নয়, অথচ আপনি আমাদের সতর্ক থাকার উপদেশ দিচ্ছেন।” এই চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৩৬৭ হিজরির, রবিউস সানির ১০ তারিখে (ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮)।

এই প্রেক্ষাপটে যদি সৌদি আরবের যুবরাজ প্রিন্স আবদুল্লাহর পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে উল্লেখিত প্রস্তাব এবং বর্তমান যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানের অবস্থানের তুলনা করা হয়, তবে স্পষ্ট হয় যে সৌদি আরব তার প্রতিষ্ঠাতা, বাদশাহ আবদুল আযিয আল সৌদের নীতিগত অবস্থান থেকে সরে এসে ফিলিস্তিনের বিভাজন সম্পর্কিত জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যদিও বাদশাহ আবদুল আযিয এটিকে “যুলুম এবং অন্যায্য সিদ্ধান্ত” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ফলস্বরূপ, সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশ আজও ইসরায়েলকে একটি আইনি ও বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।

ইসরায়েল এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে নাকি এটি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে, তা কয়েক দিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে ফিলিস্তিন এবং ইয়াহুদিদের ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের নীতিগত ও বৈধ অবস্থান, যেটিতে বাদশাহ আবদুল আযিযও অটল ছিলেন, সেখান থেকে শাহ আবদুল্লাহ এবং আজকের বিন সালমানের বিচ্যুতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বিশ্ব রাজনীতিতে একটি বড় ও বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটতে চলেছে।

Exit mobile version