রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুদ্ধজীবন: মানবজাতির জন্য শিক্ষা | অষ্টাদশ পর্ব

✍🏻 আবু রাইয়ান হামিদী

গাযওয়ায়ে বদর থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুচ্ছের ধারাবাহিক আলোচনায় আজ আমরা আপনাদের সম্মুখে আরও কয়েকটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও হৃদয়-নিবিড় শিক্ষা উপস্থাপন করছি।

১৪. বিনীত ক্রন্দন ও হৃদয়াবেগপূর্ণ খোদাভীতির গুরুত্ব

আমরা সকলেই পরম পরাক্রমশালী সত্তা আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট, তাঁর গোলাম এবং জীবনের প্রতিটি ক্লিষ্ট কিংবা সুগম পরিস্থিতিতে আমরা তাঁরই সহায়তা ও নিকটত্বের প্রয়োজনে নতজানু। যদিও আল্লাহর রাসূল ﷺ অবিচল বিশ্বাস রাখতেন যে, বিজয় মুসলিমদেরই হবে; কারণ ঐশী ঘোষণা দ্বারা তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। তবুও তিনি ﷺ সারারাত একটি সামান্য তাঁবুর অভ্যন্তরে উন্মুক্ত করজোড়ে তাঁর প্রভুর সামনে নিবেদন করে গেছেন, ক্রমাগত আর্ত মিনতি করেছেন তাঁর সাহায্য লাভের আশায়।

এমনকি যখন ভবিষ্যৎ বিজয়ের ঘোষণা তাঁর হৃদয়ে নিশ্চিন্ততার রেখা এঁকে দিয়েছিল, তখনও তিনি বিনীত ও কাতরভাবে প্রার্থনায় লিপ্ত থেকেছেন। কেননা নিছক বিশ্বাস নয়, বরং এক অনুপম দাসত্বই মানব অস্তিত্বের পরম গন্তব্য। মানুষের অস্তিত্ব এই দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।

দাসত্ব— এটি মাখলুকের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। এমনকি আল্লাহর রাসূল ﷺ-ও তাঁর রাসূলিয়তের চাইতেও এই ‘আব্দ’ পরিচয়কে অধিক মর্যাদা দিতেন। এজন্যই তিনি সাহাবায়ে কিরামকে বলতেন: “তোমরা বলো, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।”

আর এই দাসত্বই পরম সত্তার নিকট তাঁর অন্যান্য সকল গুণের তুলনায় অধিক প্রিয়। দাসত্বের নির্যাসেই প্রার্থনা হয় গ্রহণযোগ্য। মহান আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ করো, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট ফরিয়াদ করছিলে, তখন তিনি তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যে, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পর পর আগমনকারী এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করব’।” —সুরা আনফাল: ৯

অপরদিকে আবু জাহল— যে দাসত্বের পবিত্র চাদরকে ছিঁড়ে ফেলে অহংকার ও উদ্ধততার পথে অগ্রসর হয়েছিল, সে কি পার্থিব কিংবা পারলৌকিক কোনো কল্যাণ অর্জন করতে পেরেছিল?

সে আত্মম্ভরিতায় বলেছিল: “আমরা বদরে গমন করব, উট জবাই করব, জনতাকে খাওয়াব, গানের আসর বসাব, যাতে আরবদের মাঝে আমাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে।”

কিন্তু এই দাম্ভিক উচ্চারণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাবই তার ধ্বংসের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ পরম সত্তা এমন কোনো অহংকার ও ঔদ্ধত্যকে পছন্দ করেন না, কিবরিয়ার মহত্ত্ব কেবল তিনিই ধারণ করতে পারেন, এবং এই গুণ অন্য কারো মাঝে বিরাজ করলে তা অসহনীয় ও ধ্বংসাত্মক।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেখানেই দম্ভ ও উদ্ধততা একান্ত খাঁটি দাসত্বের সম্মুখে উপনীত হয়েছে, সেখানেই বিজয় লাভ করেছে বিনয় ও আনুগত্যের পতাকা। কারণ আল্লাহ তাআলা দাসত্বের পক্ষেই সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন।

১৫. গাযওয়ায়ে বদরে প্রকাশিত কয়েকটি অলৌকিক নিদর্শন

গাযওয়ায়ে বদরের প্রাঙ্গণে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মাধ্যমে কয়েকটি অলৌকিকতা (মুজিযা) প্রকাশ পেয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল— তিনি কাফিরদের নিহত হওয়ার স্থানসমূহ পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন।

যদিও এই ঘটনাটি বাহ্যিকভাবে এমন ইঙ্গিত দিতে পারে যে নবীগণ অদৃশ্য বিষয়ে (গায়েব) জ্ঞান রাখেন, বাস্তবিক অর্থে তা নয়। গায়েবের প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র পরম আল্লাহর কাছেই সীমাবদ্ধ।

তিনি বলেন, “বলুন: আসমানসমূহে ও পৃথিবীতে যাই কিছু আছে, কেউই গায়েবের জ্ঞান রাখে না—সর্বস্বজ্ঞ আল্লাহ ব্যতীত; এবং তারা জানেও না কখন পুনরুত্থিত হবে।” —সুরা নামল: ৬৫
আরও বলেন, “গায়েবের চাবিগুলি কেবল তাঁর কাছেই রয়েছে; তিনি ব্যতীত কেউ সেগুলির জ্ঞান রাখে না। এবং তিনি জানেন যা কিছু স্থলে ও জলে রয়েছে।” —সুরা আন‘আম: ৫৯

তবে আল্লাহ তাঁর মনোনীত নবীদের ওহীর মাধ্যমে কিছু গায়েবি সংবাদ দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, এই জ্ঞান তাঁদের নিজস্ব অর্জন নয়, বরং পরম প্রভুর দান যা তাঁদের মুজিযা ও নবুয়তের সত্যতা প্রতিপাদনের জন্যই।

আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ এমন নন যে তিনি তোমাদের গায়েবের জ্ঞান প্রদান করবেন, তবে তিনি তাঁর রাসূলদের মধ্য থেকে যাঁকে ইচ্ছা, তাঁকে নির্বাচিত করেন (এই জ্ঞান দান করার জন্য)।” —সুরা আলে ইমরান: ১৭৯
আরও বলেন, “তিনি গায়েবের জ্ঞাতা; তিনি কাউকেই তাঁর গায়েবের উপর অবহিত করেন না, তবে সেই রাসূলকে যিনি তাঁর নিকট মনোনীত।” —সুরা আল-জিন: ২৬–২৭

মুফাসসিরগণ এ আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, কিছু নবীকে আল্লাহ গায়েবি জ্ঞান দান করেছেন, যেন তা তাঁদের অলৌকিকতা হিসেবে প্রতিভাত হয়। যেমন, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “আমি তোমাদের জানিয়ে দিই, তোমরা কী খাও এবং তোমাদের গৃহে কী সংরক্ষণ করে রাখো।” —সুরা আলে ইমরান: ৪৯

এই কথা তিনি তাঁর কওমের কাছে মুজিযা হিসেবে বলেছিলেন।

তেমনি গাযওয়ায়ে বদরের প্রেক্ষাপটে আল্লাহর রাসূল ﷺ-কে ওহির মাধ্যমে কাফিরদের মধ্যে উমাইয়া ইবন খালাফের মৃত্যুর স্থান, আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের গুপ্তধনের সংবাদ, এবং অন্যান্য কাফিরদের পতনের স্থানসমূহ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

Exit mobile version