সাতাশ ডিসেম্বর; শত্রুদের আগ্রাসনের পর আফগানিস্তান ও উলামায়ে কেরামের কেন্দ্রীয় ভূমিকা

✍🏻 মাওলানা আবদুস সামাদ শাকির

ইসলামী ব্যবস্থার শুভ্র পতাকার ছায়াতলে এই নতুন ও সতেজ আফগানিস্তান, যে তার স্বাধীনতা এবং মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নতুন করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে; সমসাময়িক ইতিহাসে আক্রমণ, দখলদারিত্ব এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের অনেক তিক্ত অধ্যায় অতিক্রম করেছে। যার মধ্যে একটি ছিল ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৯-এর আক্রমণ, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্ররা চালিয়েছিল।

২৭ ডিসেম্বর কেবল একটি সামরিক আক্রমণের সূচনা ছিল না; বরং এটি ছিল একটি বৈশ্বিক ভ্রান্ত মতাদর্শ কমিউনিজমকে স্পষ্টভাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ঠিক যেভাবে গত বিশ বছরের সময়কাল (মার্কিন দখলদারিত্ব) ছিল একটি নতুন ধাঁচের দখলদারিত্ব; যা ছিল নরম, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের এক স্পষ্ট উদাহরণ।

এই লেখাটি সেইসব অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধের পর বর্তমান আফগানিস্তানের পর্যালোচনা এবং উলামায়ে কেরামের কেন্দ্রীয় ভূমিকার ওপর আলোকপাত করে–

দখলদারিত্ব কেবল সামরিক বিষয় নয়
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, দখলদারিত্ব মানে কেবল ট্যাঙ্ক, বিমান, বন্দুক ও সেনাবাহিনী নয়; বরং এটি একটি জাতির সঠিক চিন্তা, আকিদা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচয় মুছে ফেলার এক সমন্বিত যুদ্ধ। ২৭ ডিসেম্বরের সোভিয়েত আগ্রাসন কমিউনিজম নিয়ে এসেছিল, আর গত মার্কিন আগ্রাসন সাথে এনেছিল লিবারেলিজম, সেকুলারিজম ও বস্তুবাদী সংস্কৃতির উপহার। উভয় আগ্রাসনের মূল চেষ্টা ছিল:
১. আফগানদের ঈমানের শিকড় দুর্বল করা।
২. স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামকে স্তব্ধ করা।
৩. স্বাধীন চিন্তার পরিবর্তে গোলাম মানসিকতা তৈরি করা।

এজন্যই এটা বলা সঠিক যে, কুফরি আগ্রাসনের অবসান মানে কেবল বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার নয়; বরং সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর আসল এবং সবচেয়ে বড় যুদ্ধ শুরু হয় চিন্তা ও মূল্যবোধের ময়দানে।

‘লাঠি বনাম ট্যাঙ্ক’ দর্শন; ঈমানের শ্রেষ্ঠত্ব
তুর্কি আমলের ‘লাঠি বনাম ট্যাঙ্ক’ দর্শন; যা আফগান বীর জাতির ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়, তা কেবল কোনো আবেগীয় স্মৃতি নয়, বরং ইসলামী সংগ্রামের একটি মৌলিক নীতি। লাঠি যদিও দুর্বল অস্ত্রের প্রতীক, কিন্তু সেই লাঠির সাথে মিশে থাকা খাঁটি তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত হয়।

এই দর্শন প্রমাণ করে যে, যুদ্ধের ফয়সালা অস্ত্রের ওজন দিয়ে নয়, বরং আকিদার শক্তি দিয়ে হয়। এই একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এবং পরে ন্যাটোর বিরুদ্ধে দেখা গেছে। এতে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে, শত্রু তখনই পরাজিত হয় যখন জাতি তাকে নিজের চোখে অবৈধ ঘোষণা করে, আর এটি কেবল ঈমান ও সত্যের সন্ধানের মাধ্যমেই সম্ভব।

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বিপজ্জনক ধাপ
যখন আক্রমণকারী ও তাদের ট্যাঙ্কগুলো অধিকৃত ভূমি থেকে চলে যায় কিন্তু তাদের আদর্শ থেকে যায়; যখন আগ্রাসন শেষ হয় কিন্তু তার সাংস্কৃতিক প্রভাব বলবৎ থাকে, তখনই সেই সময়টি যেকোনো জাতির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়। এই ধাপে:
১. ইনসাফের জায়গা দখল করে নেয় প্রতিহিংসা।
২. বহিঃশত্রুর জায়গা দখল করে নেয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
৩. মানুষ ক্লান্তি ও হতাশার বশবর্তী হয়ে নিজের মূল্যবোধ সস্তায় বিক্রি করে দেয়।

এজন্যই বলা যায়, স্বাধীনতা কেবল সফলতা নয়, বরং এটি একটি বড় পরীক্ষা।

উলামায়ে কেরামের ঐতিহাসিক দায়িত্ব
বহিরাগত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রতিটি মুজাহিদ সম্মুখ সমরে থাকে; কিন্তু পরবর্তী ধাপে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বর্তায় আলেম সমাজের ওপর। এমন নাজুক সময়ে উলামায়ে কেরামের মৌলিক দায়িত্বগুলো হলো:
১. ক্ষত নিরাময়
আগ্রাসনের পর উলামাদের দায়িত্ব কেবল শারীরিক ক্ষত নিরাময়ে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতগুলো অনেক বেশি মনোযোগের দাবি রাখে। কারণ এই পর্যায়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসা একটি জাতির জন্য কোমল ব্যবহার, প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের প্রচণ্ড প্রয়োজন হয়।
২. রাষ্ট্রশক্তি ও জনগণের মধ্যে ভারসাম্য
আলেমদের ক্ষমতার গোলাম হওয়া উচিত নয়, আবার ফিতনা সৃষ্টিকারীও হওয়া উচিত নয়। আলেমের মর্যাদা হলো তিনি হকের শুভাকাঙ্ক্ষী হবেন এবং বাতিলকে প্রতিরোধ করবেন।
৩. বিভেদ প্রতিরোধ
ইতিহাস সাক্ষী যে, আফগানিস্তান প্রতিবারই প্রথমে ভেতর থেকে দুর্বল হয়েছে এবং এরপর শত্রু তার ওপর প্রবল হয়েছে। তাই উলামাদের উচিত এমন সময়ে ঐক্যের শেষ দুর্গ হওয়া। নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য মিম্বর ব্যবহার করা বা ব্যক্তিগত রুচির খাতিরে জাতীয় সীমা লঙ্ঘন করা তাদের উচিত নয়।
৪. স্বাধীনতার শরয়ী সংজ্ঞা
স্বাধীনতা মানে কেবল বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্তি নয়; বরং প্রকৃত স্বাধীনতা হলো যখন সিদ্ধান্ত, আইন, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ইসলাম এবং জাতীয় বিবেকের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাস্তবতা ওলামায়ে কেরামই সবচেয়ে ভালো বোঝেন এবং এ কারণে এর সবচেয়ে বড় দায়িত্বও তাদের ওপর বর্তায়।
৫. উলামারা চুপ থাকলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে
ওলামায়ে কেরামের চুপ থাকা উচিত নয়; প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা, শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক ও তাত্ত্বিক যুক্তিতে কথা বলা, হকের ওপর অটল থাকা এবং জনগণকে সচেতন রাখা তাদের কর্তব্য। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, যখন উলামারা চুপ হয়ে যান, তখন ময়দান মূর্খদের হাতে চলে যায়; নসিহত বা উপদেশ ত্যাগ করা হলে স্বৈরাচার জন্ম নেয়, আর যখন ইনসাফ স্তব্ধ হয় তখন ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই ওলামাদের নীরবতা শত্রুর আগ্রাসনের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।

উপসংহার
আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমান যুগে আফগানিস্তানে যারা আগ্রাসন চালিয়েছে, তারা আফগানদের সাহস ও দৃঢ়তার সামনে টিকতে না পেরে পরাজিত হয়েছে। এই মুজাহিদদের সংগ্রাম, কোরবানি ও বীরত্ব থেকে একটি বড় শিক্ষা নেওয়া জরুরি। আর তা হলো, আফগানিস্তান তখনই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন এবং অন্যের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে যখন:
• আফগানদের হৃদয়ে ‘লাঠি বনাম ট্যাঙ্ক’-এর চেতনা জীবিত রাখা হবে।
• ঈমান ও তাওয়াক্কুলের দার্শনিক চেতনা বাকি থাকবে।
• এবং উলামায়ে কেরাম এই জমিনের ক্ষতের ওপর মলম হবেন, নতুন ক্ষতের কারণ হবেন না।

যদি এই তিনটি উপাদান একত্রিত হয়, তবে ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে আর কেউ এই ভূখণ্ডে আগ্রাসনের স্বপ্নও দেখতে পারবে না। আর এই দায়িত্ব সবচেয়ে ভালোভাবে উলামায়ে কেরামই আঞ্জাম দিতে পারেন; এটাই তাদের মহান দায়িত্ব।

Exit mobile version