২০০১ সালের ৭ই অক্টোবর আমেরিকা ও ব্রিটেন প্রিয় ভূমি আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানো শুরু করে। যদিও মৌখিকভাবে কিছু মুসলিম এবং অমুসলিম দেশ এর প্রতিবাদ জানায় এবং দুঃখ-শোক প্রকাশ করে, তবু মাসের পর মাস পর্যন্ত আক্রমণের তীব্রতায় কোনো হ্রাস ঘটেনি।
সেসময়ের আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ. বুশ সময়ে সময়ে ঘোষণা করে যাচ্ছিল যে, আক্রমণের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত করা হবে, যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী রাখা হবে, এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও আফগানিস্তানে উপস্থিতি বজায় রাখা হবে।
যদিও বাহ্যিকভাবে এসব আক্রমণের কারণ হিসেবে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, তালেবান সরকার আরব মুজাহিদ উসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রে হস্তান্তর করছে না, এজন্য তালেবান সরকারকে শাস্তি হিসেবে আক্রমণের সম্মুখীন করা হচ্ছে; তথাপি এই আক্রমণে নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিক ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষরাও লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। সাধারণ মানুষকে টার্গেট করা এবং বুশের ঘোষণাসমূহ থেকে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আসল উদ্দেশ্য তা নয়; বরং এ অজুহাতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় সামরিক উপস্থিতির পথ প্রশস্ত করাই মূল লক্ষ্য ছিল।
যেমন প্রারম্ভে উপসাগরীয় আরব অঞ্চলে ইরাক ও কুয়েতের বিবাদ উত্তেজিত করে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল, তেমনি ওই সময় আফগানিস্তানের বিষয়টিও ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল করা হয়েছে যাতে ঐ অঞ্চলে সেনাবাহিনী নামানোর ধারণাসম্ভবতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর লক্ষ্য ছিল তীক্ষ্ণভাবে তালেবান কর্তৃক ইমারাতে ইসলামিয়ার ধারাবাহিকতামূলক আদর্শগত ব্যবস্থা অপসারণ করা, এবং সেইসঙ্গে ওই অঞ্চলে চীন, রাশিয়া, ইরান ও মধ্য এশিয়ার প্রভাব ও সামরিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণে আনা; পাশাপাশি মধ্য এশিয়ায় তেল, গ্যাস, লিথিয়াম এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদের বড়ো একটি অংশের ওপর আগেভাগে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করাও এই উদ্দেশ্যের অংশ ছিল।
এর আগেই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ. বুশ ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ধারাবাহিকভাবে বলত যে, তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে না, ইসলামীধর্ম তাদের কাছে শান্তিপ্রিয় ধর্ম এবং মুসলিমরা শান্তিপ্রিয় লোক। কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই জর্জ বুশ এটাকে ক্রুসেড বলে অভিহিত করে, এবং তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও যুদ্ধের সূচনার পর একটি নিবন্ধে তালেবান সরকারের পদ্ধতিকে ব্যঙ্গ ও সমালোচনার আঙ্গিকে উপস্থাপন করে, যা তাদের প্রকৃত অনুভূতিকে প্রকাশ করে।
এই রাষ্ট্রগুলোর ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড থেকে পুরো ইসলামী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ইঙ্গিত মিলল যে, এই যুদ্ধে লক্ষ্য শুধু উসামা বিন লাদেনও ও কেবল তালেবান সরকার নয়; বরং উম্মাহর সব জিহাদি আন্দোলন, দীনি মহল এবং যারা কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত সকল কিছুই টার্গেট ছিল। বাস্তবে পশ্চিম এই দীনি জাগরণ ও প্রবণতাগুলোকে নিবারণের উদ্দেশ্যেই মাঠে অবতীর্ণ হয়েছিল।
সেসময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার একটি নিবন্ধে, যা ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ১৩ অক্টোবর ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়, ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানকে নিশানা করে উল্লেখ করেছিলেন: “তালেবান ও উসামা বিন লাদেন একটি কৌশলী ও অদম্য পুরনো অনুকূলতাবাদী ও অসহিষ্ণু প্রণালী পুনরায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে।”
এর মানে হচ্ছে যে পশ্চিমের আসল উদ্বেগ ছিল—যদি ইমারাতে ইসলামিয়া ও উসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে একটি ইসলামী ব্যবস্থার স্থাপনে সফল হয়ে ওঠে, তবে তা অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে এবং সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে।
পশ্চিমের ভীতি ছিল যে যদি আফগানিস্তানে এমন একটি ব্যবস্থায় সফল হয়, তা অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। যদি তা ঘটে, তাহলে পশ্চিমের তৈরি সেই ঔপনিবেশিক ও শোষণমুখী জাল—যা ক্ষমতা ও ষড়যন্ত্রের দ্বারা মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সম্পদ শোষণ করতে সহায়তা করে, তা ধ্বংসপ্রায় হয়ে যাবে এবং হারিয়ে যাবে। আমার ধারণা অনুযায়ী পুরো ঘটনাটির মূল তৎপরতা তখনও এটাই ছিল এবং আজও তেমনই আছে; এবং অন্যান্য সব কারণই এরই চারপাশেই ঘুরে বেড়ায়।
তবে আমার ধারণা যে পশ্চিমের শোষণমূলক ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার স্বাভাবিক আয়ু সম্পন্ন করে ফেলেছে, বিশ্বব্যবস্থায় তার আঁচ কমে এসেছে, এবং এখন এটি ইতিহাসের চাকার অনুকম্পার দিকে নির্ভরশীল অবস্থায় রয়েছে।
এ কারণেই তখনও আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের, নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর বোমাবর্ষণ ও হিংস্র হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন সৃষ্টি করা হয় এবং বহু বছর তারা দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠায় কটু সময় কাটাতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু অবশেষে পশ্চিমের পুঁজিপত্তিমান ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থাকে রক্ষা করার এবং ইসলামের ন্যায্য ও স্বাভাবিক ব্যবস্থাকে রোধ করার কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি, এবং ভবিষ্যতেও এমন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা এখানে স্থায়ীভাবে সফল হতে পারবে না।
তবে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় নেতাগণ ও ইসলামী আন্দোলনগুলোর জন্য এখানে একটি পরীক্ষা রয়েছে—তারা কতদূর একে অপরের সঙ্গে সংযোগ, পরামর্শ, ধৈর্য ও সহায়তা বজায় রেখে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে।