আবু রাইয়ান হামিদী
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন এক সমাজে প্রেরন করেন— যার ভিত্তি ডুবে ছিল অন্ধকার ও অজ্ঞতার অতলে। সেই অমানিশার ঘোর থেকে মানবতার মুক্তি ঘটাতে তিনি আবির্ভূত হন এক আলোকবর্তিকা হয়ে। ইহসান, ইকরাম এবং অতুলনীয় আখলাকের মাধ্যমে তিনি মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসার আহ্বান করেন। তাঁর দাওয়াহর এ অনন্য পদ্ধতি মানব ইতিহাসে এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরকাল।
কিন্তু সমাজ তাঁর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাঁকে অস্বীকার করে, বিদ্রূপ করে, এমনকি তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করে। মক্কা তাঁর জন্য এক ভয়াবহ পরীক্ষার স্থানে পরিণত হয়। তিনি সেখানে শান্তি তো দূরের কথা, প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় আবিষ্কার করতেন। মক্কার কাফেররা আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চাইলেও, আল্লাহর পরিকল্পনায় নবীজির বার্তা আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে এবং তাঁর শত্রুরা লজ্জিত ও পরাভূত হয়।
হিজরতের মাধ্যমে নবীজির জীবন নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করে। মদিনা তাঁকে ইসলামের দাওয়াহর জন্য এক শান্তিপূর্ণ আবাস এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ প্রদান করে। আউস ও খাযরাজের শত বছরের শত্রুতা তাঁর মহত্ত্বপূর্ণ উপস্থিতির আলোয় সম্প্রীতি ও ঐক্যের অটুট বন্ধনে পরিণত হয়। মদিনা একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে শুরু করে।
তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শান্তি ও স্থিতির মধ্যে দু’টি বড় হুমকির মুখোমুখি হন।
প্রথম হুমকি ছিল কুরাইশদের থেকে। মদিনায় ইসলামের উত্থান কুরাইশদের জন্য ছিল ভবিষ্যতের এক বড় শঙ্কা। নবীজির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিবেশীদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, যা কুরাইশদের দৃষ্টিতে ছিল তাদের কর্তৃত্বের জন্য হুমকি। তারা বারবার হুমকি দিয়ে জানায়, হিজরত নবীজিকে তাদের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। এই শত্রুতাপূর্ণ পরিস্থিতি নবীজির অন্তরে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল, বিশেষত তাঁর সাহাবিদের সুরক্ষা নিয়ে।
দ্বিতীয় হুমকি এসেছিল ইয়াহুদিদের পক্ষ থেকে। ইতিহাসের পাতাগুলি তাদের ধূর্ততা, বিদ্বেষ এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সমাজে বিষ ছড়ানোর দাস্তান দিয়ে ভরপুর। মদিনাতেও তারা একই ভূমিকা পালন করে। তারা প্রকাশ্যে নবীজির প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করত এবং গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকত।
তখনো নবীজিকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়নি। আল্লাহর পক্ষ থেকে ধৈর্যের নির্দেশ ছিল তাঁর প্রতি। সমস্ত নির্যাতন ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি এবং তাঁর সাহাবিরা সেই নির্দেশ মেনে চলেন। তবে তাঁদের অন্তর প্রতীক্ষায় ছিল, কখন আল্লাহর অনুমতি আসবে, যাতে তাঁরা অত্যাচারের মোকাবিলা করতে পারেন এবং ইসলামের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন।
অবশেষে হিজরতের দ্বিতীয় বছরে সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধের অনুমতি আসে এবং নাযিল হয় পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত,
”أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَٰتَلُونَ بِأَنَّهُمۡ ظُلِمُواْۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ نَصۡرِهِمۡ لَقَدِيرٌ“
অর্থ: যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো; কারণ তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। (সূরা আল হাজ্জ ২২:৩৯)
এভাবেই শুরু হয় ইসলামে যুদ্ধের যুগ। বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে ইসলামের মর্যাদা ও গৌরবের পতাকা দুনিয়ার বুকে উড্ডীন হতে থাকে।
নবীজির জীবনীকারগণ তাঁর যুদ্ধগুলো দুইভাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন। কেউ কেউ শুধুমাত্র সেসব যুদ্ধের ওপর আলোকপাত করেছেন যেখানে সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, যেমন বদরের যুদ্ধ। আবার কেউ কেউ এমন অভিযানকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন যেখানে কোনো যুদ্ধ হয়নি, যেমন আল আবওয়ার অভিযান।
এই সিরিজে শুধুমাত্র সেই যুদ্ধগুলোর ওপর আলোচনা করা হবে যেখানে সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। নবীজির যুদ্ধকৌশল, যুদ্ধ পরিচালনার প্রজ্ঞা, সেসব ঘটনার শিক্ষাগুলো এবং শত্রুর ভুল বোঝাবুঝি থেকে সংঘটিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।