আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইসলামী ইমারাতের সম্পর্ক [ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব ]

✍🏻 ওয়ালিদ ওয়াইয়ার

ইতিহাসের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে এমন কোনো নজির পাওয়া যায় কি, যেখানে কোনো জাতীয় সরকার জনগণের সমর্থন ও সম্মতির অনুপস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে? আফগানিস্তানে ইসলামী ইমারাতের পুনরুত্থানের অন্তর্নিহিত রহস্য মূলত এই এক সত্যে নিহিত— এই শাসনব্যবস্থা জাতির অন্তরের আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই জনসাধারণ, যারা ইতোমধ্যেই শূন্যস্বরে উচ্চারিত গণতন্ত্রের প্রতারণাপূর্ণ স্লোগান, পাশ্চাত্য-অনুগত নেতৃত্ব এবং তাদের অনুগত দখলদার বাহিনীর জঘন্য ছায়ায় ক্লান্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল; তারা এমন এক সুবর্ণ মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল, যেখানে তারা নিজ ধর্ম এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুশীতল ছায়ায় এক খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যয় লাভ করতে পারবে।

তারা এমন নেতার প্রত্যাশায় ছিল, যিনি এই মাটির সন্তান, যিনি মসজিদ ও হুজরার আবহে গড়া, আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা বিদেশি ভূমির পাসপোর্ট বহনকারী, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে রঞ্জিত স্যুট-পরা ‘বিশেষজ্ঞ’ কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নয়, যারা জীবনভর বিদেশি প্রভুদের খেদমতে নিজেদের মেধা নিঃশেষ করেছে, আর অবসরের শেষ বেলায় আফগানিস্তানে সেবার মোড়কে লুটপাট ও দুর্নীতির গোপন অভিসারে ফিরে এসেছে।

সমকালীন বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র, যারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজ নিজ জনপ্রিয়তা ও বৈধতার ধ্বনি তোলে, প্রকৃতপক্ষে তারা সেই শূন্যতা পূরণে ব্যস্ত, যা তাদের ক্ষমতার ভিত্তিতে এক কালিমাপূর্ণ ইতিহাস এবং আপসহীন বাস্তবতার রূপে বিরাজমান। কেননা এই শাসনগুলো অধিকাংশই স্বৈরতান্ত্রিক প্রকৃতির এবং বিদেশি শক্তির সমর্থন কিংবা কৃত্রিম মিশনের প্রভাবেই ক্ষমতালাভ করেছে; একপ্রকার প্রজেক্ট বা প্রকল্পে রূপান্তরিত হয়েছে তারা। এই কারণেই আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আফগানিস্তানের ইসলামী ইমারাতের প্রতি সেই পুরোনো বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবই পোষণ করে, কারণ এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এক গণমুখী বিপ্লবের ফসল, যা তাদের প্রণীত কূটনৈতিক নীতিমালার বিপরীত স্রোতে গড়ে উঠেছে।

আজকের আফগানিস্তানে যে শান্তির আবহ, যে সামাজিক স্থিতি এবং যে নির্মাণ-পরিকল্পনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতীয় অর্থায়নে অগ্রসর হচ্ছে, তার প্রতিটি অনুষঙ্গই কি এই সাক্ষ্য দিচ্ছে না যে, এই অবকাঠামোগত অগ্রগতি এক সুদৃঢ় অভ্যন্তরীণ স্বীকৃতি এবং নিরঙ্কুশ জাতীয় সমর্থনের ফল?

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পর্যালোচনার দাবি রাখে, তা হলো মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া। ইসলামী ইমারাতের অভূতপূর্ব সাফল্য তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে; কারণ তাদের সমগ্র রাজনৈতিক কর্মনীতি আমেরিকা ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যের ইঙ্গিতেই পরিচালিত হয়। এ কারণেই তারা আজ অবধি ইমারাতকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে একটুকুও এগোয়নি। তারা এমন এক আতঙ্কময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সত্তার ছায়ায় দিনাতিপাত করছে, যেখানে পশ্চিমের নীতিমালার প্রতি সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণ তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্র ও স্বার্থের জন্য সংকট ডেকে আনতে পারে। অথচ তাদের অতি সুস্পষ্টভাবে জানা যে, আফগানিস্তানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা এক অনুসরণযোগ্য ইসলামী আদর্শ, যা শান্তি, গণসমর্থন ও জাতীয় বৈধতার এক অনুপম মডেল।

চার দশকের অধিক সময় ধরে যে জাতি অবিরাম যুদ্ধ, রক্তপাত ও অস্থিরতার অভিশাপ বহন করেছে, তারা সর্বাত্মক শান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রত্যাশায় অন্তরভরে প্রার্থনা করেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সে প্রার্থনা পূরণ করেছেন ইসলামী ইমারাতের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এখন আন্তর্জাতিক মহল যতই দ্বিচারিতা প্রদর্শন করুক, এবং নিজেদের রচিত নীতিমালার পরিপন্থী পদক্ষেপ গ্রহণ করুক, তাদের বিবেক ও ইতিহাসের মানচিত্রে কেবল কলঙ্কের ছাপই সংযোজিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে, আফগান জাতির দীর্ঘকালের আকাঙ্ক্ষা আজ পরিপূর্ণ হয়েছে।

যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অর্থ হয় আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, এমনকি ব্যক্তিগত মর্যাদাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা, আফগানিস্তানকে পুনরায় এক রাজনৈতিক ও সামরিক পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত করা, তবে এমন স্বীকৃতির প্রতি ধিক্কার বর্ষিত হোক।

আমরা আমাদের নিজস্ব জাতীয় বৈধতার সুফলই ভোগ করছি এভাবে যে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। এটিই এক বিশাল বিজয়। যেসব তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ অন্য ইসলামি রাষ্ট্রগুলো লাভ করেছে, তা যদি আজ আমাদের ভাগ্যে না-ও জোটে, তবে নিশ্চয়ই আগামীকাল পৃথিবী স্বীকার করবে আমরা ইতোমধ্যেই অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী চল্লিশের অধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেছি এবং এই সম্পর্কের বৃত্ত ক্রমশই সম্প্রসারিত হচ্ছে।

গত তিন বছরে পার্শ্ববর্তী ও আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে যে, ইসলামী ইমারাতের পররাষ্ট্রনীতি পরিপক্ব, ভারসাম্যপূর্ণ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও নিরপেক্ষতায় পূর্ণ। এই নীতি তাদের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ নয়, বরং তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ সংরক্ষণের এক নির্ভরযোগ্য উপায়।

অতএব, নিশ্চিতভাবে বলা যায় এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর কাজ হলো এই অর্জিত জাতীয় সংহতিকে সুসংহত করা এবং সেই বিশুদ্ধ জনসমর্থনের ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেওয়া, যা ইসলামী ইমারাতকে প্রাণ ও প্রেরণা জুগিয়েছে, এবং প্রতিটি পদক্ষেপে যার অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। অন্যভাবে বললে, যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিনিময়ে আমাদের জাতীয় ঐক্য, স্থিতি ও শরঈ বৈধতাকে বিসর্জন দিতে হয়, তবে কোনো সুজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি— যিনি আফগানিস্তানের সমকালীন ইতিহাস ও তার বহুবিধ জটিলতা সম্পর্কে অবহিত, কখনোই এমন আত্মঘাতী বিনিময়ে সম্মত হবেন না।

Exit mobile version