দাঈশ খাওয়ারিজের বিরুদ্ধে ইসলামী ইমারাতের যুদ্ধ: পর্দার অন্তরালের প্রেরণা কী?

✍🏻 আবদান সাফী

যখন থেকে মার্কিন কংগ্রেস আফগানিস্তানের জন্য অর্থসহায়তা বন্ধ করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, তখন থেকেই কিছু মিডিয়া সংস্থা ও স্বার্থান্বেষী বিশ্লেষক এমন ধরনের গুজব ছড়াতে শুরু করেছে যে, এই সিদ্ধান্ত হয়তো ইসলামী ইমারাতের দাঈশ (ISIS) বিরোধী প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করবে। এই মন্তব্যগুলো হোক অজ্ঞতা থেকে উৎসারিত অথবা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত, বাস্তবতার সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটি এক ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা, যা আফগানিস্তানের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও জনগণের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আস্থা ও সন্তুষ্টিকে অগ্রাহ্য করার নামান্তর।

ইসলামী ইমারাত আফগানিস্তান—একটি জনভিত্তিক, ইসলামী এবং ইতিহাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত এমন এক আন্দোলনের নাম, যা দুই দশক ধরে দখলদারিত্ব ও যুদ্ধাবস্থার অবসান এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। এর বিপরীতে দাঈশ একটি আমদানিকৃত, তাকফিরি ও চরমপন্থী ফিতনার নাম, যা ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কিছু গোয়েন্দা সংস্থার চক্রান্তে আফগানিস্তানে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এখানেও অস্থিরতা ও অরাজকতার আগুন ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায়।

ইসলামী ইমারাতের দৃষ্টিতে দাঈশ একটি বিদেশি গোষ্ঠী, যার কোনো ইসলামি ভিত্তি নেই, কোনো শরয়ি গ্রহণযোগ্যতা নেই; না এটি জনসমর্থন লাভ করেছে, না মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টিতে এটি প্রশংসনীয় বা গ্রহণযোগ্য; বরং এটি একটি ফিতনাবাহী দল, যারা উম্মাহর ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করেছে, মুসলিমদের তাকফির করেছে, আলেম থেকে শুরু করে নিরপরাধ মুসলমান ও নিষ্পাপ শিশুদের রক্ত ঝরিয়েছে, এবং ইসলামকে আড়াল বানিয়ে ইসলামেরই আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

ইসলামী ইমারাতের দৃষ্টিতে দাঈশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল নিরাপত্তার অনিবার্যতা নয়, বরং একটি শরয়ি কর্তব্য, দায়িত্ব ও উম্মাহর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই যুদ্ধে মূল লক্ষ্য সেই খারেজি মানসিকতাকে দমন করা, যা না ঐক্য ও সংলাপকে স্বীকার করে, না উলামায়ে কেরামের মর্যাদাকে মানে, না উম্মাহর স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়। এই যুদ্ধ কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং দীনের পবিত্রতা সংরক্ষণের যুদ্ধ; শহীদদের রক্তের মর্যাদা রক্ষার যুদ্ধ; এই যুদ্ধ আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য পরিচালিত হচ্ছে, ওয়াশিংটন বা অন্য কোনো কেন্দ্র থেকে সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশায় নয়।

গত কয়েক বছরে ইসলামী ইমারাত দাঈশের সঙ্গে কঠিন ও নজিরবিহীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে—এমন সময়, যখন তাদের হাতে কোনো সরকার ছিল না, কোনো বাজেট ছিল না, না ছিল আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি কিংবা বিদেশি সহায়তা। তার পরেও তারা নাঙ্গারহার থেকে শুরু করে  কাবুল পর্যন্ত দাঈশের শিকড় উপড়ে ফেলেছে। এই সংগ্রাম কেবল অস্ত্রের জোরে নয়, বরং জনগণের সমর্থন, আলেমদের দিকনির্দেশনা এবং নিজেদের আকীদার প্রতি অটল বিশ্বাসের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে। ইসলামী ইমারাতের দৃষ্টিতে দাঈশের বিরুদ্ধে লড়াই একটি ইসলামি, শরয়ি, জাতীয় ও নৈতিক দায়িত্ব; এটি কোনো বিদেশি চাপ বা লোভ-প্রলোভনের ফল নয়।

অন্যদিকে, এই দাবি—আমেরিকার সাহায্য বন্ধ হলে দাঈশ বিরোধী লড়াই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, একেবারেই ভিত্তিহীন। কেননা এই যুদ্ধ সেই সময় থেকেই চলছে, যখন আমেরিকা নিজেই আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে রেখেছিল। তবুও ইসলামী ইমারাত দাঈশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে। বরং বহুবার এমন দৃশ্যও দেখা গেছে যে, আমেরিকান বিমান দাঈশ যোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করেছে অথবা তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাহায্য করেছে। এমনকি এমন প্রমাণও রয়েছে যে, দাঈশের হাতে এমন প্রযুক্তি ও অস্ত্র পৌঁছেছিল, যা কেবলমাত্র মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের হাতে থাকার কথা।

সুতরাং বাস্তবতা সম্পূর্ণ স্পষ্ট—ইসলামী ইমারাতের দাঈশ বিরোধী যুদ্ধ কেবল নিজেদের সম্পদ, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, মতাদর্শিক দৃঢ়তা ও জনসমর্থনের উপর নির্ভরশীল; কোনো বিদেশি সাহায্যের উপর নয়।

এ ছাড়া এ কথাও স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, আফগান জনগণের হৃদয়ে দাঈশের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা বিদ্যমান। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে আলেম, গোত্রপ্রধান এবং তরুণ সমাজ—সকলের মাঝেই দাঈশ বিরোধী তীব্র বিদ্বেষ রয়েছে। দাঈশের আদর্শ আফগান জনগণের জন্য একটি বহিরাগত, অগ্রহণযোগ্য ও রক্তাক্ত মতবাদ। ইসলামী ইমারাত এই আফগান জাতির ইচ্ছা, নেতৃত্ব ও কণ্ঠস্বরের প্রতিচ্ছবি—সুতরাং এই যুদ্ধ জনতার সমর্থনে চলছে, কোনো বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে নয়।

অতএব, যদি আমেরিকা সাহায্য বন্ধ করে, তবে তা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে; কিন্তু এর ফলে না ইসলামী ইমারাতের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, না জনসমর্থন দুর্বল হবে, না জিহাদি সংকল্পে কোনো ফাটল ধরবে। বরং বিপরীতভাবে, এই সিদ্ধান্ত ইসলামী ইমারাতের আত্মনির্ভরতা, স্থিতিশীলতা ও জাতীয় সমর্থনের ভিত্তিতে গঠিত শাসনব্যবস্থাকে আরও মজবুত করবে।

স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, ইসলামী ইমারাত ও দাঈশের মধ্যে এই যুদ্ধ একটি ঈমানি যুদ্ধ, একটি অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ, উম্মাহর ঐক্য এবং উম্মতে মুসলিমার আকীদা ও মতাদর্শ রক্ষার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অর্থের জন্য নয়, খ্যাতির জন্য নয়, কোনো রাজনৈতিক স্বীকৃতির জন্যও নয়; বরং এটি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” ধ্বনির আহ্বানকারীদের এবং “খারেজি”দের মধ্যকার এক পবিত্র সংঘাত, যা চলতেই থাকবে, যতক্ষণ না ফিতনার সমাপ্তি ঘটে এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।

Exit mobile version