আইএস একটি মহামারির নাম | অষ্টাদশ পর্ব

✍🏻 আবু হাজার আল কুর্দি

শামে দাঈশের দ্বারা সংঘটিত অপরাধসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

গত সতেরো পর্বে শামে দাঈশের দখলকৃত বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত তাদের অপরাধসমূহের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে এবং উম্মতের ক্ষতবিক্ষত দেহে তাদের বিষাক্ত খঞ্জরের আঘাতের চিহ্ন তুলে ধরা হয়েছে। যদিও সকল ঘটনা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি, তথাপি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত ও ছোট ছোট পর্যবেক্ষণগুলোই এই বিভ্রান্তিদুষ্ট গোষ্ঠীর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ স্পষ্ট করতে যথেষ্ট।

শামে দাঈশ যে অপরাধ ও নেতিবাচক প্রভাব রেখে গেছে, এবং যা ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে, তা নিম্নরূপ:
১. অন্যান্য জিহাদি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ:
দাঈশ মূল শত্রু বাশশার আল আসাদের সরকার এবং তার সহযোগী বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর পরিবর্তে তাদের কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত করে অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে। তারা প্রথমে শামে আল কায়েদার শাখা ‘জাবহাতুন্নুসরাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এবং পরে ‘আহরারুশ শাম’ ও ‘জাইশুল ইসলাম’সহ অন্যান্য মুজাহিদ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এসব গৃহযুদ্ধ শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের কাতার দুর্বল করে দেয়।

২. মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা:
দাঈশ অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার পরিবর্তে তাদের ‘কাফির’ বলে আখ্যায়িত করে এবং যে দলই তাদের সঙ্গে বাইআত না করতো, তাকেই তারা শত্রু মনে করত। এই নীতি বহু মুসলিমের হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয়, যারা জিহাদের উদ্দেশ্যে শামে গিয়েছিলেন, এবং এর ফলে তারা জিহাদ থেকে বিমুখ হয়ে পড়েন। সেইসাথে এ প্রবণতা সকল জিহাদি দলের মাঝে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করে।

৩. বর্বরতা ও জিহাদের ভাবমূর্তি কলুষিত করা:
দাঈশের নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ, যেমন গণহত্যা, শিরোচ্ছেদ, শরিয়তের বিধান উপেক্ষা করে হদ্‌দ প্রয়োগ— এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দেয় যাতে পশ্চিমা মিডিয়া ও ইসলামবিরোধী শক্তিসমূহ জিহাদ ও মুজাহিদীনদের নেতিবাচক চিত্র উপস্থাপন করে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বহু মুসলিমের অন্তরে গভীর ক্ষত তৈরি করে, যারা একসময় শামে চলমান জিহাদের সমর্থক ছিলেন।

৪. সন্দেহজনক সহযোগিতা এবং শত্রুপক্ষের এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া:
কিছু প্রমাণ ও বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে দাঈশ বিভিন্ন সময়ে পরোক্ষভাবে আসাদ সরকারের ও এমনকি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থে কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, দাঈশ প্রায়শই এমন এলাকায় হঠাৎ হামলা চালাতো যেখানে আসাদবিরোধী বাহিনী অবস্থান করত, যার ফলে বিরোধী জোট দুর্বল হয়ে পড়তো এবং সরকারপন্থীরা অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেত।
এছাড়াও কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী, আসাদ সরকার এমন কয়েকজন পুরনো বন্দিকে মুক্তি দেয় যাদের দাঈশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, যাতে এ গোষ্ঠী আরও শক্তিশালী হয়ে অন্যান্য ইসলামী গোষ্ঠীগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে।

৫. ইসলামী খেলাফতের মহান ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা:
শরঈ শর্ত ও উপযুক্ত প্রশাসনিক প্রস্তুতি ছাড়াই খেলাফতের ঘোষণা দিয়ে দাঈশ ইসলামী খেলাফতের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বহু মুসলিম যারা প্রাথমিকভাবে খেলাফতের প্রতিষ্ঠার আশায় ছিল, তারা দাঈশের হাতে সংঘটিত অপরাধ দেখে এই মহান লক্ষ্যের প্রতি নিরুৎসাহী ও হতাশ হয়ে পড়েন। এ মনোভাব মুজাহিদীন এবং জিহাদপন্থীদের মধ্যে হতাশা ও নিরাশার এক গাঢ় পরিবেশ সৃষ্টি করে।

এই পর্যায়ে এসে আমরা শামে দাঈশের অপরাধ নিয়ে আলোচনার ইতি টানছি। যদিও আমরা এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ হক আদায় করতে পারিনি, তবুও আশা করা যায় সম্মানিত পাঠকগণ পূর্ববর্তী পর্বগুলো থেকে উপকৃত হয়েছেন এবং সংক্ষেপে হলেও সেই অন্ধকার ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন, যা বাগদাদির অনুসারীরা তাদের নৃশংসতা ও বর্বরতা দ্বারা লিপিবদ্ধ করেছিল।

এই ধারাবাহিক আলোচনার পরবর্তী পর্বে আমরা ইরাকের সুন্নি মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঈশের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের ব্যাখ্যা করব এবং এই সিরিজকে অব্যাহত রাখব।

Exit mobile version